বাপ্পী খায়ের: আহা, আট কোটি দশ লাখ ডলার সমান কত টাকা! দেশে বিদেশে লাখ লাখ শ্রমিকের শ্রম ঝরা টাকা। সেই টাকায় ঘামের গন্ধ। এই টাকা রোজগারের জন্য তারা প্রিয়জনের মায়ার বন্ধন ছিঁড়ে পেছনে ফেলে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। মৃত্যুকে বুকে পেতে আলিঙ্গন করে। ইজ্জত বিসর্জন দেয়। বিদেশে যায় কাজ করতে। টাকা রোজগার করতে।
তারপর সেই টাকা দেশে আসে, আবার বিদেশের সিন্দুকে যায়। সেই সিন্দুক ভাঙা পড়ে টাকা চলে যায় দস্যুদের হাতে। আমার গরিব দেশের লাখ লাখ মানুষ দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ায় নিয়ত, আর দেশি-বিদেশি দস্যুরা সব মিলে সিন্দুকে সযতনে তুলে রাখা টাকা ডাকাতি করে নিয়ে যায়।
ওরা সিকিউরিটি কোড ভাঙে, ওরা সিন্দুক ভাঙে, ওদেরকে সিন্দুক ভাঙার কাজে দস্যুরা সহায়তা করে; চোরে আর ডাকাতে মাসতুত ভাই। আমি সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ নই, কোনো রাজনীতিবিদ নই, কোনো অর্থনীতিবিদ নই; এই ছোট্ট গ্রহে কোটি কোটি পোকামাকড়ের ঘরবসতি, সবই পোকা। পোকারা বেঁচে থাকে মানুষের গায়ের ওপর দিয়ে, মানুষকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়।
সিকিউরিটি একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়। আসল ব্যাপারটি হলো মানবীয় ও সাধারণ জ্ঞানের। আমি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে থাকতে একবার সানফ্রান্সিসকো গিয়েছিলাম এক রিসার্চ কনফারেন্সে। সেখানে তিন তারকা হোটেলে চেকইন করতে আমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করি। পরদিন কনফারেন্সের মাঝখানে ব্যাংক থেকে টেক্সট মেসেজ ও ইমেইল আসে। তার পরপরই ফোন আসে। আপনার ক্রেডিট কার্ড থেকে সন্দেহজনক লেনদেন হচ্ছে, এটা কি আপনি করেছেন? প্রশ্নকর্তা অবশ্যই আমাকে বিষয়টি জানানোর আগে আমি আসল ব্যক্তি কি না সেটা বিভিন্নভাবে যাচাই করে নেন।
আমার উত্তর, না। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে জবাব, কোনো চিন্তার কারণ নেই স্যার, আমরা আপনার এই ক্রেডিট কার্ড ব্লক করে দিচ্ছি এবং আপনাকে একটা নতুন কার্ড পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তার পাশাপাশি আমরা এই ঘটনাটা তদন্ত করব। আপনাকে কোনো দায় বহন করতে হবে না এটার জন্য। আপনার এইটুকু অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। জালিয়াতিটা ওই হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে বসা দস্যুটা করার চেষ্টা করেছিল।
আরেকবার এক গ্যাস স্টেশনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার পরপরই একই ঘটনা ঘটেছিল। এ রকম আরও অনেকবার ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড জালিয়াতির সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু আমি ক্ষতিগ্রস্ত হইনি। এসব ক্ষেত্রে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হন না যদি না তিনি সেই লেনদেন অনুমোদন করে। এগুলো আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের কথা। তখনই সিকিউরিটি সিস্টেম ছিল এমন, কোনোরকম সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করে আটকে দেওয়া এমন কোনো বিষয়ই ছিল না।
এখন তো প্রযুক্তি আরও উন্নত, স্মার্ট। গ্রাহকের কার্ড ব্যবহারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি লেনদেনের ইতিহাস সিস্টেম বোঝে। গ্রাহকের দৈনন্দিন লেনদেনের পর্যালোচনা করে সিস্টেম অতি সহজেই কোনোরকম সন্দেহজনক কার্যকলাপ থামিয়ে দিতে পারে। কোনো কোনো ব্যাংক এমনও করে, আপনি যে জায়গায় থাকেন তার বাইরে কোথাও কার্ড ব্যবহার করতে গেলে তাদের আগে থেকে জানিয়ে যেতে হয়, নতুবা তারা কার্ড ব্লক করে দেয়।
এসব ব্যবস্থাই কিন্তু ওই দস্যুদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য। তবু মানুষ প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষা পায় অথবা পায় না। ছোট ছোট ব্যাংক, ছোটখাটো গ্রাহকদের রক্ষার জন্য এমন সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে রেখেছে। আর লোহার সিন্দুকে বুঝি তাবৎ বিশ্বের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এমনি এমনি ফেলে রেখে দেওয়া হয়, এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হয়, সিন্দুকের দারোয়ান ঘুমায়, মালিক ঘুমায়! অথবা কে জানে আমার স্বল্প বুদ্ধিতে হয়তো এসব বড়সড় কাজকারবার কুলায় না।
আমার দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, খেটে খাওয়া শ্রমিক, ইটভাটায় মাথার ঘাম পায়ে ঝরানো শিশুর বিবর্ণ চেহারা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কিশোরীর গায়ের ঘামে ভেজা ছেঁড়া কাপড়, বিদেশে পুরুষ আর নারী শ্রমিকের দাসত্বের জীবনে মরে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়া। কবে যেন কোন এক ফিডে দেখলাম, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে মনিবের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার এক নিরপরাধ শ্রমিক, এ রকম শত শত দৃশ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানে ওখানে।
নারী শ্রমিকদের বিদেশে ভালো চাকরির কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর ওরা হাতবদল হতে হতে গিয়ে পৌঁছোয় নরকের নিচতলায়। তারপর ওদের উপার্জনের টাকা দেশে আসে, অতঃপর চলে যায় দস্যুদের হাতে। এদের আরও কত না-জানা করুন গল্প আর মুছে যাওয়া অশ্রুজলের গঙ্গা নদী শুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে আছে কোথায় কোন অজানায় হে বিধাতা!
চোর কে জানি না, ডাকাত কে জানি না, আমার দেশের গরিব মানুষের ডাকাতি হওয়া টাকা ফেরত চাই। না হলে মনে রেখো, আমরাও একদিন পোকা হব, নরকের কীট হব, তারপর তোমাদের গা ছিঁড়েখুঁড়ে খাব। আমি দুর্বল, আমি অর্ধমৃত, আক্রান্ত; আমার মুখ বাঁধা, আমি কথা বলতে পারি না, আমার হাত পা বাঁধা, আমি প্রতিবাদ করতে পারি না, আমি কিছুই করতে পারি না, আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি, আমার চারপাশে বীভৎস হিংস্র হায়েনার বসবাস। শুধু দুফোঁটা অশ্রুজল সযতনে আগলে রেখে দিতে পারি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য!
*লেখক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।