সাঈদ শিপন : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির নগদ লভ্যাংশের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়করমুক্ত ঘোষণা করা হলেও এ সুবিধা পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
তালিকাভুক্ত কোম্পনিগুলো উৎসে কর হিসেবে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ থেকে গণহারে তা কেটে নিচ্ছে।
এর ফলে করমুক্ত এ সুবিধা শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আর বাস্তবে সে সুবিধা না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পর্যালোচনায় জানা যায়, বছর শেষে কোম্পানিগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করে, তাতে বাজার দর হিসেবে অর্জিত লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ড ইয়েল্ড) খুবই কম। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করে, তাতে অর্জিত লভ্যাংশের পরিমাণ ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে, লভ্যাংশের ওপর যে আয়কর সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে, সে সুবিধা না পাওয়ার কারণে বিনিয়োগকরীদের অর্জিত লভ্যাংশের পরিমাণ আরো কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে আমানতে ঝুঁকি না থাকা সত্ত্বেও ১০ শতাংশের বেশি বার্ষিক লভ্যাংশ অর্জিত হয়। সে হিসাবে শেয়ারবাজারে অর্জিত মুনাফা ব্যাংকের বা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার চেয়ে অনেক কম।
বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য দেওয়া প্রণোদনার অংশ হিসেবে সরকার ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশে কর ছাড়ের সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে তা না পাওয়ায় এ প্রণোদনা কাজে আসছে না।
সম্প্রতি, কোম্পানিগুলো তাদের দেওয়া লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি যোগ করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ওয়ারেন্টি পেপার (লভ্যাংশ ও কর্তনকৃত কর সংক্রান্ত চিঠি) দেওয়া হয় না। ফলে, কর্তনকৃত কর সমন্বয়ের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
আজিজুর রহমান মিয়া নামে এক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেন, তার কাছে বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির ৬০টি শেয়ার ছিল। ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ হিসেবে তিনি ৯০ টাকা লভ্যাংশ পেয়েছেন। তার এ লভ্যাংশের ওপর ১০ শতাংশ হারে ৯ টাকা কর কেটে নেওয়া হয়েছে। একই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে থাকা সাউথইস্ট ব্যাংক ও সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড কোম্পানির লভ্যাংশেও ১০ শতাংশ হারে কর কেটে নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও লভ্যাংশের পরিমাণ ১০০ টাকার কম। শুধুমাত্র একজন আজিজুর রহমানের ক্ষেত্রেই নয়, আয়কর কেটে রাখার বিষয়টি প্রায় সব বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রেই ঘটছে বলে জানা গেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ সাজিদ হোসেন বলেন, ‘কর ছাড়ের বিষয়টি ঘোষণা থাকলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এ নিয়ে আইনে অসঙ্গতি রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। সৈয়দ সাজিদ বলেন, ‘একজন বিনিয়োগকারী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ধারণ করেন। আবার কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন রেকর্ড ডেট ঘোষণা করে। রেকর্ড ডেটে যার কাছে শেয়ার থাকবে, তিনিই লভ্যাংশের দাবিদার হবেন। কিন্তু কোনো কোম্পানির পক্ষে একজন বিনিয়োগকারীর কাছে অন্য কোম্পানির রেকর্ড ডেটে কী পরিমাণ শেয়ার রয়েছে এবং তার ডিভিডেন্ডের পরিমাণ কত তা জানা সম্ভব হয় না। সে জন্য প্রতিটি কোম্পানিই ঝামেলামুক্ত থাকার জন্য লভ্যাংশের ওপর গণহারে আয়কর কেটে রাখছে। জটিলতা নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি মনে করেন, প্রতিটি কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘোষিত লভ্যাংশের ওপর পৃথকভাবে আয়কর সুবিধা দেওয়া হলে বিনিয়োগকারীদের এ সুবিধা পেতে সমস্যা হবে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান নির্বাহী ড. স্বপন কুমার বালা বলেন, ‘সব বিনিয়োগকারীর জন্য কর ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হলেও এটি আসলে সবাই পাচ্ছেন না। কর ছাড়ের এ সুবিধা পেতে হলে বিনিয়োগকারীদেরও কিছু সক্ষমতা থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে লভ্যাংশের ওপর অতিরিক্ত কর কেটে নেওয়া হলে তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় কোম্পানির দেওয়া লভ্যাংশ সংক্রান্ত ওয়ারেন্টি পেপার জমা দিলে অন্য আয়করের সঙ্গে অতিরিক্ত কর সমন্বয় করা হবে। এ সুবিধা তারাই পাবেন যাদের (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) টিআইএন রয়েছে এবং যাদের আয় আয়করযোগ্য। কিন্তু, যাদের টিআইএন নেই, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর কেটে নিলেও কিছু করার নেই।’
এদিকে, টিআইএন রয়েছে কিন্তু অন্যান্য আয় আয়করযোগ্য নয়, সেক্ষেত্রে তিনিও অতিরিক্ত কর সমন্বয়ের সুবিধা পাচ্ছেন না।
লভ্যাংশের ওপর আয়কর সুবিধা পেতে অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পদ্ধতিগত কিছু বিষয়ে সংস্কার করা হলে বিনিয়োগকারীরা এ সুবিধা পেতে পারেন।’
উল্লেখ্য, শেয়ার বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে চলতি অর্থবছরে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু, আয়করমুক্ত লভ্যাংশের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলেও সুবিধা না পাওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
Leave a Reply