কামাল আহমেদ: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অভিবাসীদের ভূমিকা ধীরে ধীরে যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তা আর কেউ না বুঝুক, প্রায় কোটি খানেক বাংলাদেশি অভিবাসীর পরিবারগুলো খুব ভালোই বোঝে। ইদানীংকালে রাজনীতিকেরা ভোটের প্রয়োজনে অভিবাসীদের সমর্থন পাওয়ার আশায় মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ভালো কথাও বলে থাকেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিতে এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় তাঁদের সেসব সুবচনের প্রতিফলন তেমন একটা ঘটে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টিকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে।
বৈশ্বিক পরিসরে ব্যাংকিং ব্যবসায় নিয়োজিত বড় কয়েকটি ব্যাংকের একটি হচ্ছে ব্রিটিশ ব্যাংক বার্কলেজ। ব্রিটেনে বাংলাদেশি মালিকানাধীন ছোটখাটো মানি ট্রান্সফার এজেন্সিগুলোর অধিকাংশই এই বার্কলেজে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের হিসাব পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু বার্কলেজ ৬০ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে ওই সব অ্যাকাউন্ট গত জুন মাসে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এসব এজেন্সিকে নোটিশ দেয়। মূলত সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় অর্থায়ন, মাদকের টাকা পাচার ও কালোটাকা বিদেশে পাচারের মতো বেআইনি কাজে জড়িত থাকার জন্য কিছু বহুজাতিক ব্যাংককে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণে জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। যার পরিণতিতে এসব ব্যাংক এ ধরনের টাকা স্থানান্তরের ঝুঁকি কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। উঁচু হারে মুনাফা করার লক্ষ্য ও নানা ঝুঁকিপূর্ণ কারবারের কারণে চাপে থাকা এসব ব্যাংক সাম্প্রতিক কালে তাদের ব্যবসার খরচ কমানোর দিকটিতে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়েছে। ফলে বৃহদাকারের ব্যবসার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়া তারা অব্যাহত রাখলেও প্রশাসনিক ব্যয় কমানোর জন্য ছোট আকারের ব্যবসায় তারা আর সেই ঝুঁকি নিতে রাজি হচ্ছে না। ফলে খেসারত দিতে হচ্ছে এসব ছোটখাটো মানি ট্রান্সফার এজেন্সিকে।
১৯৯৭ সালে যখন পেশাগত কারণে লন্ডনে অভিবাসী হই, তখন লন্ডন থেকে বাংলাদেশে বৈধভাবে টাকা পাঠানোর জন্য একমাত্র ভরসা ছিল সোনালী ব্যাংক। তবে বাস্তবে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে যতটা টাকা দেশে যেত, তার চেয়ে বেশি যেত হুন্ডির মাধ্যমে। গত এক দশকে ওই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এবং বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন অন্তত ডজন খানেক মানি ট্রান্সফার এজেন্সি, তাদের কয়েক শ এজেন্ট ও সাব-এজেন্ট এখন এই সেবা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি সক্রিয় আছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মানি ট্রান্সফার এজেন্সি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও মানিগ্রাম। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও মানিগ্রামের মতো বহুজাতিক মানি ট্রান্সফার সংস্থার বিশ্বব্যাপী নিজস্ব নেটওয়ার্ক থাকায় তাদের ব্যবসার পরিধি অনেক বিস্তৃত। কিন্তু ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও মানিগ্রামে টাকা পাঠানোর খরচ অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃতভাবে কিছুটা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবাসীদের আস্থা অর্জন করছিল। বৈধ পথে টাকা লেনদেনের সুবিধা হলো তাতে নজরদারি সম্ভব, কিন্তু বেআইনি পথে টাকা গেলে সেটা সন্ত্রাসবাদের বিস্তারে ব্যবহূত হওয়ার ঝুঁকিটা আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী গত অর্থবছরে (২০১১-১২) ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো টাকার পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং পঞ্চম প্রধান রেমিট্যান্সের উৎস। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার। অন্যদিকে, ব্রিটিশ সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা দপ্তরের প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্রিটেনের বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ হচ্ছে ২০ কোটি পাউন্ড বা ৩০ কোটি ডলার। অর্থাৎ ব্রিটেন বাংলাদেশকে যে পরিমাণে উন্নয়নসহায়তা দেয়, তার প্রায় তিন গুণ অর্থ পাঠান প্রবাসীরা।
ব্রিটিশ সরকারের উন্নয়নসহায়তা অন্য দাতাদের মতোই দেশের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি খাতের মধ্যেই সীমিত (যার মধ্যে চরাঞ্চলের ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের মতো কার্যক্রম যেমন রয়েছে, তেমনি আছে বিবিসির ব্যয়বহুল বাংলাদেশ সংলাপ ও ইংরেজি শেখানোর খরচ)। এগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আবার পরামর্শক (কনসালট্যান্ট) ফি হিসেবে ব্রিটেনেই ফিরে যায়। অন্যদিকে, প্রবাসীদের টাকা ব্যয়ের খাত যেমন কোনো কিছুতে সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি তার পুরোটাই দেশের ভেতরেই থেকে যায়। এরপর রয়েছে বিভিন্ন দাতব্য বা সেবামূলক খাতের জন্য প্রবাসীদের দান। যেমন চলতি বছরেই জাকাত ও ফিতরা সূত্রে মুসলিম চ্যারিটিগুলোর সংগ্রহ ১০ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্রিটেনের সেভ রেমিট্যান্স গিভিং ক্যাম্পেইনের চেয়ারম্যান রুশনারা আলী এমপি।
গত বছরের নভেম্বরে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা, আঙ্কটাড তার এক রিপোর্টে দেখিয়েছে, বিশ্বে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ব্যবসাটিতে কার্যত কয়েকটি কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে এই টাকা পাঠানোর খরচ অনেক উঁচুতেই থাকছে। আঙ্কটাডের ওই রিপোর্ট বলছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় টাকা পাঠানোর খরচ বিশ্ব গড়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। তাদের হিসাবে, স্বল্পোন্নত দেশের অভিবাসীরা যে পরিমাণ টাকা পাঠান, তার প্রায় ১২ শতাংশই খরচ হয় ওই টাকাটা পাঠাতে। আঙ্কটাড এই টাকা পাঠানোর খরচ কমানোর জন্য আরও বেশি সংখ্যায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা লেনদেনের ব্যবসায় সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব করেছে। তারা বলছে, ক্ষুদ্রঋণের কাজ করে, এমন প্রতিষ্ঠান ও পোস্ট অফিসগুলো তাদের গ্রাম পর্যায়ের নেটওয়ার্কের কারণে কম খরচে দ্রুততার সঙ্গে এই টাকা পাঠানোর কাজটি করতে পারবে বলে তাদের বিশ্বাস। অথচ মনে হচ্ছে, পশ্চিমা দুনিয়া বরং উল্টো পথেই হাঁটছে এবং একচেটিয়া ব্যবসায় নিয়োজিত বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করছে।
বার্কলেজ এসব মানি ট্রান্সফার এজেন্সিকে তাদের হিসাব অন্য কোথাও স্থানান্তরের ৬০ দিনের সময় দিয়ে যে চিঠি দেয়, তা শেষ হওয়ার কথা ছিল গত জুলাইয়ের গোড়ার দিকে। তারপর নানা দেনদরবার, আবেদন-নিবেদন ও লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের অনুরোধে বার্কলেজ আরও এক মাস সময় বাড়াতে রাজি হয়, যা শেষ হয়েছে গত সপ্তাহে। ইতিমধ্যে রুশনারা আলীর উদ্যোগে শরিক হন আরও ৪৬ জন এমপি এবং ক্রীড়াজগতের তারকা সোমালীয় বংশোদ্ভূত দৌড়বিদ মো ফারাহ। এসব রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের মুখে বার্কলেজ কোনো কোনো এজেন্সিকে আরও মাস খানেক সময় দিলেও এসব হিসাব তারা বন্ধ করার সিদ্ধান্তে এখনো অনড়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক সোনালী ব্যাংক কি এসব এজেন্সির সহায়তায় কিছু করতে পারে? নাকি তারাও একই ধরনের ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে সেটা সম্ভব নয়? বিষয়টি নিয়ে একাধিক মানি ট্রান্সফার এজেন্সির স্বত্বাধিকারী, সোনালী ব্যাংক ইউকের প্রধান নির্বাহী এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল, তাতে সমস্যাটা বোঝা গেলেও সমাধানের বিষয়ে তেমন একটা আশাব্যঞ্জক কিছু শোনা গেল না। অন্যরা যা বলেছেন, ঠিক তেমনটাই জানালেন সোনালী ব্যাংক ইউকের প্রধান নির্বাহী আতাউর রহমান প্রধান। সোনালী ব্যাংক ইউকে ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংক হলেও তারা ইংল্যান্ডের ক্লিয়ারিং হাউসের সদস্য নয়। আন্তব্যাংক লেনদেন ও বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে তারা নির্ভর করে ক্লিয়ারিং হাউসের সদস্য ব্রিটিশ ব্যাংক ন্যাটওয়েস্টের ওপর। আর ন্যাটওয়েস্ট সোনালীর লেনদেন চালাতে রাজি থাকলেও সোনালীর কোনো এজেন্ট বা সাব-এজেন্টের হিসাবের লেনদেনে রাজি নয়। তাদের যুক্তিও এক, ওই সব এজেন্সির লেনদেনের ঝুঁকি গ্রহণ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তো সোনালী ব্যাংক নিজে কেন ক্লিয়ারিং হাউসের সদস্য হচ্ছে না? সোনালী ব্যাংক ইউকের ব্যবসার পরিমাণ খুবই ছোট হওয়ার কারণে এবং তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় সেটি সম্ভব নয়।
ব্রিটেনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম এক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) কিছু শর্ত সাপেক্ষে ন্যাটওয়েস্টকে সোনালী ব্যাংকের এজেন্ট ও সাব-এজেন্টদের হিসাব পরিচালনার অনুমতি দিলে বিষয়টির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান সম্ভব। সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী জানিয়েছেন, তাঁরা এ বিষয়ে এফসিএর অনুমতি চেয়ে আবেদন করে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। যদি সে অনুমতি না মেলে, তাহলে বাংলাদেশের মালিকানাধীন ওই সব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাবে বলে সবার আশঙ্কা।
বৈধ পথে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থায় যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার সমাধানে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে হাইকমিশন থেকে চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক পর্যায়ে বিষয়টি উত্থাপনের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ব্রিটিশদের সরকারি উন্নয়ন সহায়তার তুলনায় রেমিট্যান্সপ্রবাহের গুরুত্ব যে কতটা ব্যাপক, সেটা তুলে ধরে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধক অপসারণে ক্যামেরন সরকারের হস্তক্ষেপ চাওয়া নিশ্চয়ই অবাস্তব কিছু হবে না। ৪০টি দেশের দূতাবাসের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এইচএসবিসি ব্যাংকের অনুরূপ উদ্যোগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে বলে জানা যাচ্ছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের ফোরামে, বিশেষ করে সেপ্টেম্বরের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে প্রবাসী-আয়ের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকে জোটবদ্ধ করে অভিবাসীদের স্বার্থ ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় প্রস্তাব উত্থাপনের উদ্যোগও নিতে পারে বাংলাদেশ। কেননা, কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছে।
উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আমল থেকে অবাধে দুনিয়া চষে বেড়ানো পশ্চিমাদের বিশ্বব্যাপী চলাচলের অবাধ স্বাধীনতা এখনো বজায় আছে। পণ্য, পুঁজি এমনকি জীবজন্তুর চলাচল অবাধ করার পক্ষে তাদের ওকালতির শেষ নেই। তাদের শুধু আপত্তি, তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের চলাচলের স্বাধীনতায়—তা সে উন্নত জীবনের আশায় হোক কিংবা যুদ্ধ-সংঘাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাড়নাতেই হোক। আমাদের রাজনীতিকেরা কি এ বিষয়ে কোনো দিন সোচ্চার হবেন?
কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো।
Leave a Reply