সবার মুখে এক কথা। সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে? নির্বাচনই এই আশঙ্কার প্রধান কারণ। নির্বাচন আদৌ হবে কি না, হলেও কীভাবে হবে? আর সে নির্বাচনটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে কি না, এটাও আলোচনার বিষয়। জাতীয় সংসদের বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। এ মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নতুন সংসদের জন্য নির্বাচন হওয়ার কথা।
সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে সে নির্বাচনের সময় শুরু হবে আগামী ২৫ অক্টোবর ২০১৩। এর পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন পরিচালনায় সামগ্রিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের প্রস্তুতি রয়েছে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালের জুন মাসে বাতিল হয়ে যায়। সংবিধান অনুসারে নির্বাচন পরিচালনার সময়েও বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় থাকার কথা। এই অবস্থা থেকে কোনো ধরনের ছাড় দিতে সরকার সম্মত নয়। অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধী দল ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। জটিল পরিস্থিতি। পক্ষদ্বয় পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে, এ প্রত্যাশা সবার। তবে নির্বাচনকালে কী ধরনের সরকারপদ্ধতি দেশে থাকবে, তা স্থির না হওয়ায় আমরা একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে রয়েছি। ধরে নিলাম রাষ্ট্রশক্তির প্রবল দাপটে সরকার একটি একতরফা নির্বাচন করিয়ে নেবে। অন্যদিকে বিরোধী দল নির্বাচন ভন্ডুল করে দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করল। সে ক্ষেত্রে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সুতরাং এখনই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি আপস ফর্মুলা বের করতে উভয় পক্ষকে সচেষ্ট হতে হবে।
দ্বিতীয় আলোচনার বিষয় হলো নির্বাচনের প্রস্তুতি। দেশে বেশ কয়েকটি সফল ও ব্যর্থ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কমিশনের রয়েছে। সুতরাং তারাও সাবধানে পা ফেলবে, এমনটাই সবাই আশা করে। সংবিধান বা নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি বিতর্কে কমিশন যাবে না, এটা স্বাভাবিক। তবে নির্বাচনে যাতে সব দল অংশ নেয়, তার জন্য প্রশাসনিক ও আইনি কিছু ব্যবস্থার কথা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। প্রধান সমস্যা আস্থার সংকট। বরাবরের মতো বিরোধী দলের শঙ্কা হচ্ছে নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকা সরকারি দল অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে বিজয় ছিনিয়ে নেবে। মূলত এ সমস্যাটি জনপ্রশাসন ও পুলিশের দলীয়করণ থেকে উদ্ভূত। আর এর সুরাহা না হওয়াতেই চালু করতে হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান।
২০০৭ সালে গঠিত নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে সে সরকারের সহায়তায় অনেক আইনি ও বিধিগত সংস্কার করে। রাজনৈতিক সরকারের সময়েও এগুলো কিছুটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ফলে বর্তমান সরকারের মেয়াদে জাতীয় সংসদের কয়েকটি উপনির্বাচন ও সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও পক্ষপাতহীন হয়েছে। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কিছু প্রভাব বিস্তারের ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের গলদ হয়নি। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনের একই মানে অনুষ্ঠিত হবে, এর নিশ্চয়তার বিধান নির্বাচন কমিশনকেই করতে হবে। তার জন্য তাদের প্রয়োজন প্রধান সব রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কমিশন তা হারাতে বসেছে। প্রধান বিরোধীদলীয় জোট আগে থেকেই কমিশন সম্পর্কে কিছুটা আস্থাহীনতায় ভুগছিল। কমিশনও তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান জোরদার করে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পেরেছে বলা যাবে না। তাদের সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রম সে ঈপ্সিত নিরপেক্ষতার ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এমনকি মহাজোটের শরিক এরশাদও কমিশন সম্পর্কে আস্থাহীনতার কথা বলছেন। যা-ই হোক, কমিশন যে তাদের গ্রহণযোগ্যতার ভিতে ফাটল ধরিয়েছে, এটা অধিক আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। আর এ ফাটল দ্রুত ও কার্যকরভাবে জোড়া দিতে না পারলে নিশ্চিতভাবেই আগামী সংসদ নির্বাচনে সব প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে না। যদি তা-ই ঘটে, সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই বটে, তবে তারা বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপের প্রস্তাব ও প্রশাসনিক কার্যক্রম দ্বারা সে রাজনৈতিক সমস্যার মাত্রা কমাতে পারে। বিরোধী দলের শঙ্কা দূর করতে কমিশন সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনের অনুরূপ নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে কমিশন দৃঢ় অবস্থানে থাকলে তা অসম্ভব নয়।
২৫ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার কথা। সেই ভোট গ্রহণ পর্ব ভিন্ন ভিন্ন দিনে এলাকাভিত্তিক অনুষ্ঠিত হতে পারে। ধরা যাক, ১০ দফায় ভোট গ্রহণ হলে প্রতি দফায় গড়ে ৩০টি নির্বাচনী এলাকা ও ছয় হাজার ভোটকেন্দ্র থাকবে। ভোটের ফলাফল গণনা করতে হবে সব ভোট গ্রহণ পর্ব শেষে এবং একই দিনে। এর আগে সংশ্লিষ্ট জেলা সদরে সুরক্ষিত কোনো ভবনে এগুলোকে উপযুক্ত প্রহরায় সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবেই ভারতে ভোট গ্রহণ করা হয়। অবশ্য এর জন্য আবশ্যক হবে রাজনৈতিক মতৈক্য এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও বিধিমালা সংশোধন। এভাবে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করলে নির্বাচনকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তাবলয় শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের নজরদারিও একইভাবে বেড়ে যাবে। নির্বাহী বিভাগের অপপ্রয়োগের আশঙ্কাও হ্রাস পাবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন আইন পরিবর্তনের দাবি করতে পারে। যথাযথ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে আইনি সংস্কারের আবশ্যক, তা তুলে ধরা তাদেরই দায়িত্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা তা না করে বরং উল্টো পথে হাঁটছে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন প্রস্তুতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক যে নিরাপত্তাব্যবস্থা, সে সম্পর্কে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা তারা নিয়েছে বলে মনে হয় না। কয়েক দিন আগে জনৈক দায়িত্বশীল মন্ত্রী আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সামরিক বাহিনী আবশ্যক হবে না বলে একটি উক্তি করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে দেশে ওভারপাস কিংবা রাস্তা নির্মাণেও সেনাবাহিনীকে ডাকতে হয়, সেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের বাদ রাখার চিন্তাই করা যায় না। এমনকি কয়েক দিনে ভাগ করে ভোট গ্রহণ করলেও না। বেসামরিক বাহিনীগুলোর সক্ষমতা সীমিত। আর রাজনৈতিক প্রভাবে দুষ্ট হওয়ার ফলে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। স্থানীয় নির্বাচন সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের প্রশ্ন ছিল না। গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছিল প্রতিটি রন্ধ্রে। সুতরাং দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গোটা দেশে এক দিনে নির্বাচন হলে কী হবে, তা সবাই অনুমান করতে পারেন। অপ্রতুল নিরাপত্তাব্যবস্থা, নজরদারি ইত্যাদি কারণে যে যেভাবে পারে, অবৈধ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করবে। এমনকি নির্দলীয় সরকারের সময়ে এক দিনে ভোট গ্রহণ করা হলে নির্বাচনকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তাবলয়ও নাজুক থাকবে। সে ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করলে পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জনৈক মন্ত্রী সংসদ নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাঁরা যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। সিদ্ধান্তটি তাঁদেরই নেওয়ার কথা। তবে সে ‘যথাসময়টি’ কখন হবে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। আরও বোধগম্য হচ্ছে না নিরাপত্তা ভাবনা ব্যতিরেকে তাঁরা নির্বাচনের মূল প্রস্তুতিই বা কী নিলেন।
আরও দু-একটি বিষয় নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। প্রথমেই তারা একটি আচরণবিধির খসড়া প্রকাশ করে বিতর্কিত হয়। এটি নিয়ে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আলোচনা করেনি। তারপর আসে জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর কতিপয় বিধান সংশোধন নিয়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন বিধিব্যবস্থা এই আদেশে আছে। ১৯৭২ সালে জারি করা রাষ্ট্রপতির এই আদেশ আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত। তা সংশোধন বা সংযোজনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত জাতীয় সংসদ। সাম্প্রতিক কালে এ আদেশের কতিপয় অনুচ্ছেদ সংশোধন চেয়ে নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এর কতগুলো বিতর্কে আসার মতো নয়। তবে দু-একটি মৌলিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে চরম বিতর্কিত। এর একটি হচ্ছে রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক প্রার্থিতা বাছাইয়ের পরে রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ঘোষণা করার প্রস্তাব। এতে দল থেকে মনোনয়ন না পেলে সে দলের নামে যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাবে। তাঁদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকবে না। দলীয় শৃঙ্খলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে প্রস্তাবিত বিধানটি উত্তম মনে হতে পারে। এতে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকবে না। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদই দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত সাংসদদের বিবেকের অধিকার খর্ব করেছে। আর প্রধান তিনটি দলের সিদ্ধান্ত নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলে আলোচিত। সেখানে সে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে মনোনয়নপ্রার্থীদের চূড়ান্তভাবে সঁপে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, এটা বিতর্কের দাবি রাখে।
তারপর আসে আরপিওর অনুচ্ছেদ ৯১ই বাতিল প্রস্তাব প্রসঙ্গে। প্রস্তাবটি রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় সৃষ্টি করেছে। কেননা এতে কমিশন স্বেচ্ছায় তার ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাব দিয়েছে কিছু দুর্বোধ্য যুক্তিতে। এতে গুরুতর বেআইনি কার্যক্রম অথবা আরপিও কিংবা আচরণবিধির বড় ধরনের বরখেলাপের জন্য নির্ধারিত নিয়মে একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের বিধান রয়েছে। আজ অবধি এটা প্রয়োগ হয়নি, তা সত্য। তবে ধরে নেওয়া যায়, এ আশঙ্কাতেই প্রার্থীরা সংযত ছিলেন। বিধানটি বাতিল হলে ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর অনিয়ম করলেও কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে কমিশন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কমিশন যা-ই বলুক, স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার এ প্রস্তাবটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তেমনি কমিশনের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এটা যেন ফুটবল খেলার মাঠে হুইসেলবিহীন একজন রেফারি।
প্রশ্ন আসবে। আসতেই পারে। জবাবও থাকবে। তবে কমিশনকে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থাও করতেই হবে। আর সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে একটি কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-প্রক্রিয়াও খুঁজে বের করার বিকল্প নেই। সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। তা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতেই হবে। সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর রশ্মির সন্ধানে আমাদের যাত্রা থাকবে অবিরাম।
লেখক: আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। majumder234@yahoo.com
Leave a Reply