আফতাব চৌধুরী: সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত অধিকাংশ গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ইতিহাস অবৈধ মারণাস্ত্রের শক্তিতে বলীয়ান হওয়া একদল দুস্কৃতিকারী ও বিপথগামী পাশবিক দম্ভ-অহংকারীর অস্ত্রাঘাত ও রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। কোনও একটা জাতির অস্তিত্ব রক্ষার নামে শুরু হওয়া এসব সংগ্রামে কেউ রেহাই পাচ্ছেনা।
অবৈধ মারণাস্ত্র আজ শান্তিপ্রিয় সমাজের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক মারণাস্ত্রের মজুতকরণের খবর অঞ্চল বিশেষকে করে তুলেছে স্পর্শকাতর। কেননা আধুনিক মারণাস্ত্রের রমরমা সংঘাতপূর্ণ একটি জনবসতি প্রধান অঞ্চলে বা একটা বহুধা বিভক্ত জাতি-জনগোষ্ঠীর এলাকায় অভিশাপ ডেকে আনতে পারে। শান্তি-সম্প্রীতিতে সমৃদ্ধ একটি সমাজকে মুহুর্তে বিধ্বস্ত করে দিতে পারে।
সুতরাং অবৈধ মারণাস্ত্রকে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম অশুভ শক্তির বাহক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।আধুনিক মারণাস্ত্রের যুগে এখন পর্যন্ত যতগুলো ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে এর মূলে কিন্তু অবৈধ অস্ত্রশক্তি।
উল্লেখ্য, বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংঘর্ষ সমূহ সংঘটিত হচ্ছে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল তথা বিশ্বের তৃতীয় শ্রেণীর দেশগুলোয়। বিশ্বের অস্ত্র রফতানিকারী এবং ধনী রাষ্ট্রগুলো গরিব দেশগুলোতে তাদের অস্ত্রের বাজার তৈরি করছে। বৈধ-অবৈধ, দুই প্রকারের অস্ত্র বিক্রির জন্য এই রাষ্ট্রসমূহকে লক্ষ্য করে ফেলা হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রের সহজ লভ্যতায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এভাবে দ্বিতীয় পক্ষের শক্তি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছে। মৌলবাদী শক্তি হোক বা জেহাদিরাই হোক, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিই হোক বা সন্ত্রাসবাদী, এদের মূল চালিকাশক্তি অবৈধ মারণাস্ত্র।মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগের ফলাফলের কথা লক্ষ্য করে বিভিন্ন সময়ে সরকার অসামরিক লোকের হাতে থাকা অনুজ্ঞাপত্রযুক্ত অস্ত্র (বন্দুক) সমূহ সংগ্রহের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছে। সরকারের এহেন অভিযান শক্তিশালী হলে নিঃসন্দেহে শান্তিকামী জনসাধারণের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ হবে।
অবশ্য এতে তৃণমূল পর্যায়ে প্রত্যেক নাগরিকের পূর্ণ সহযোগিতা থাকতে হবে। এ মহৎ কাজ গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।প্রসঙ্গত, মারণাস্ত্রের সুপ্রয়োগ হওয়ার কোনও নজির নেই। মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগের ফলে কীভাবে ব্যাপক গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সূত্রপাত হতে পারে ও সামাজিক শান্তি বিঘিœত হতে পারে তার বর্ণনা হয়তো নি®প্রয়োজন। কিন্তু এর ফলে হতে পারা ক্ষতি যে অপুরণীয় তা উল্লেখ না করাটা অনুচিত হবে। সংঘর্ষপীড়িত এলাকায় প্রায়ই আমরা মানবতার করুন চিত্র প্রত্যক্ষ করছি। নিরীহ লোক কীভাবে আশ্রয় শিবিরে শরাণার্থীর জীবন পার করে তা আমরা দেখেছি। এর প্রধান ও সাক্ষাৎ উদাহরণ ইসরাইলের নির্যাতনে কিভাবে প্যালেষ্টাইনেরা যুগ যুগ ধরে উদবাস্তুর মত জীবন-যাপন করছে। রোহিঙ্গারা কিভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে। নরক সদৃশ সে জীবন। অথচ এসব নারকীয় হত্যাকান্ডে বা নির্যাতনে বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
এসব দেশে যে অত্যাচার নির্যাতন, ঘরবাড়ি, ধর্মীয়স্থান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হচ্ছে তাতে কি বিশ্ব বিবেক নাড়া দিবে দিবেনা- এ প্রশ্ন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সকল মানুষের।মানবসৃষ্ট কারণে মানুষের এই দুর্ভোগ অত্যন্ত পীড়াদায়ক। ১৯৯৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অস্ত্র সংঘাতের ফলে ১ কোটি ৩২ লক্ষ লোককে আশ্রয় শিবিরে শরাণার্থীর জীবন অতিবাহিত করতে হয়। ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, বিশ্বের ধনী ও মারণাস্ত্র রফতানিকারী দেশসমূহের তুলনায় গরিব এবং অস্ত্র আমদানিকারী দেশসমূহে অস্ত্র সংঘাতের ফলে মৃত্যু হওয়া লোকের সংখ্যা বহুগুণে বেশি। মানুষের দ্বারা সংঘটিত দুর্যোগে মা ও শিশু মৃত্যুর সংখ্যাই সর্বাধিক। দৃষ্টান্তস্বরূপ, প্রতি ৫ কোটি জনসংখ্যায় এরকম সংঘর্ষের ফলে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা আমেরিকায় মাত্র ১৫টি। বিপরীতে আফগানিস্তানে ১৮৩৫টি ও পাকিস্তানে ৬৬৪টি। সেভাবে গর্ভবতী অবস্থায় মার মৃত্যু সংখ্যা আমেরিকায় ৯১টি, বিপরীতে আফগানিস্তানে ১৯, ১৭৫এবং পাকিস্তানেও ৩,৯০৩। সমীক্ষাটিতে বলা হয়েছে যে, ১৯৮৬-১৯৯৬ সময়কালে বৈধ, অবৈধ মারণাস্ত্র সংঘাতের ফলে প্রায় ২ কোটি শিশুর মৃত্যু হয়, ৬ কোটি আহত হয় এবং অসংখ্য শিশু এমন নিষ্ঠুর সংঘাতের সাক্ষী হয়।
বিশ্বের সর্বাধিক মারণাস্ত্র রফতানাকারী দেশসমূহের মধ্যে আছে ক্রমে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন এবং চীন। অন্যদিকে সর্বাধিক অস্ত্র আমদানিকারী গরিব দেশসমূহের ভেতর আছে ক্রমে সিয়েরালিওন, অ্যাঙ্গোলা, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, কঙ্গো, ইথোপিওয়া, রুয়ান্ডা, পাকিস্তান, ভারত, উগান্ডা।সম্প্রতি অস্ত্র রফতানিকারী দেশসমূহ ক্ষুদ্র আকার এবং হালকা মরণাস্ত্র উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, ক্ষুদ্র আকৃতির অস্ত্রের বাজারটি সহজে বিভিন্ন প্রান্তে সম্প্রসারিত করা যায়। নির্মাণ ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে কম।
সন্ত্রাসবাদীদেরও এর ফলে সুবিধা হয়েছে।বিশ্বের গরীব দেশসমূহে মারণাস্ত্র রফতানিকারি দেশগুলো তাদের অস্ত্র বাণিজ্যের লক্ষ হিসেবে বেছে নেওয়া রাষ্ট্রগুলো সংঘাত প্রবণতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিচ্ছে এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এরা বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক তথা কুটনৈতিক কারণেও প্রয়োজন সাপেক্ষে মারণাস্ত্রকে ‘অনুদান’ হিসেবে তুলে দেয়। এমন উদাহারণ আছে। ১৯৫০-৯৬ সময়কালে পৃথিবীর ভিতরে সবেচেয়ে বেশি মারণাস্ত্র আমদানিকারির তালিকার শীর্ষে থাকা দেশটি হল পাকিস্তান এবং ভারত। কিন্তু বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে অবৈধ মারণাস্ত্রের লেনদেনের বিষয়টি ‘মুক্ত গোপনীয়’ রূপে ধরা হতো। এই সময়ে আমেরিকা সন্ত্রাসকবলিত পাকিস্তানে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের মারণাস্ত্র মুক্ত হস্তে দান করেছিল। এভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধনী দেশগুলো মারণাস্ত্র বিস্তারের সঙ্গে জড়িত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত বৃহৎ সংঘর্ষগুলোর মধ্যে ৮৫ শতাংশই গরিব দেশগুলোয় রয়েছে। মানুষের সৃষ্ট অস্ত্র সংঘাতের দুর্যোগ আফগানিস্তানে ২২ বছর ধরে, অ্যাঙ্গোলায়া ৩৫ বছর এবং সোমালিয়ায় প্রায় ১২ বছর ধরে চলছে।অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বাহিনীর সহযোগে আন্তর্জাতিক পুলিশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক কাজে জড়িত অপরাধী চক্রকে উৎখাত করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আটক করার পাশাপাশি তাদের কারখানাগুলো বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অবৈধ তথা চোরাই ব্যবসাকে সমর্থন যোগানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি তথা কোম্পানিগুলোকে এই অভিযানের লক্ষ্য হিসেবে নিতে হবে।
এ মর্মে জাতিসংঘের গৃহীতব্য পদক্ষেপের অন্যতম অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনগুলোকে অধিক শক্তিশালী করা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন তথা আন্তর্জাতিক আচরণবিধির যথাযথ প্রয়োগ ইত্যাদি জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা নিশ্চয়ই আশা করবো সংঘাতমুক্ত, শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা বন্ধ হোক। অস্ত্র রফতানিকারি দেশগুলো অনুভব করুক গরিব রাষ্ট্রসমূহের সমস্যার কথা। বিশ্ব মানবতার মর্যাদা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে কিন্তু জাতিসংঘকেই। নাকি ভূল বললাম?
লেখক: সাংবাদিক কলামিস্ট।
Leave a Reply