আশরাফুল ইসলাম: বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক মাছের বিশাল ভাণ্ডার। এছাড়া হাওরের রয়েছে বিপুল পর্যটন সম্ভাবনা। এরপরও যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-স্যানিটেশনসহ বহুবিধ ক্ষেত্রে অবহেলিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চল। হাওর বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য এক স্বতন্ত্র সত্তা। এমন বিচিত্র প্রকৃতি ও জীবনধারা বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। শুকনো মওসুমে দিগন্তবিস্তৃত মাঠের পর মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ আর অতিথি পাখির মেলা। বর্ষায় চারদিক থৈ থৈ করা পানি। যেন সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে আছে হাওরের প্রকৃতি।
হাওরের জীবন ও প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্যই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। বর্ষাকালে হাওর এলাকায় অবস্থিত গ্রামগুলোকে দূর থেকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। মনে হয় যেন হাওরের পানিতে ভাসছে সেই সব গ্রাম। এ সময় হাওরে চলাচল করে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা। এগুলোই বর্ষাকালে হাওর এলাকার বাসিন্দাদের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা কিংবা জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র বাহন। শত শত রঙিন পাল তোলা নৌকাও বর্ষায় চোখে পড়ে। জাহাজ আকৃতির মালামাল পরিবহনকারী বড় বড় কার্গো, দাঁড় বেয়ে চলা নৌকা ও মাঝিদের কণ্ঠের সুরেলা গান এসবই হাওরের অনুষঙ্গ। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে জেলেদের জাল দিয়ে মাছ ধরা তো নিত্যদিনকার চিত্র।
রাতে নৌকায় কুপি বাতি জ্বালিয়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখে দূর থেকে মনে হবে যেন গ্রাম্য কুলবধূরা শত শত প্রদীপ জ্বালিয়ে হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। হাওরের পানিতে হাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশুরা সারাদিন সাঁতার কাটায় মেতে থাকে। চাঁদনী রাতে জ্যোৎস্নার আলোর সঙ্গে ঢেউয়ের মাতামাতি দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যায়। বর্ষাকালে হাওরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই মনোরম! হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খির দেশ’ হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়। ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার ধবল বক হাওরে চোখে পড়ে। শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে।
সাঁঝের বেলায় মুক্তোর মালার মতো বিভিন্ন প্রজাতির সেসব অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার সময় মুখরিত কলকাকলীর কান ফাটানো শব্দ একমাত্র হাওর এলাকাতেই শোনা সম্ভব। হাওরে পর্যটনের এ বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে ওঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। এর জন্য বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনই উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে বলে হাওরবাসী মনে করেন। হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালালে কক্সবাজার সমুদ্র-সৈকতের মতো হাওর এলাকাও একদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ৪২৩টি হাওর নিয়ে গঠিত হাওরাঞ্চলের ১২২টি হাওর কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত।
জেলার সম্পূর্ণ হাওর অধ্যুষিত উপজেলাগুলো হচ্ছে ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও নিকলী। এছাড়া করিমগঞ্জ, কটিয়াদী, বাজিতপুর, তাড়াইল, ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলার অংশবিশেষ হাওর এলাকায় অবস্থিত। বিশাল সম্ভাবনা সত্ত্বেও সরকারের উদাসীনতা আর অযত্ন-অবহেলার কারণে এখানকার বিশাল জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্থানীয়রা জানান, কৃষি বিভাগ জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিলেও হাওরের চার উপজেলা ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও নিকলীতে বহু জমি এখনও চাষের আওতায় আসেনি। বেশি নিচু, ডোবা প্রকৃতির এবং জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণে এসব জমি চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না।
তাই ধীরে ধীরে এসব জমিকেও চাষাবাদের উপযোগী করা গেলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে তা অনেক সহায়ক হবে বলে স্থানীয় কৃষকরা জানান। সংশ্লিষ্টদের মতে, এখানকার সব জমি এক ফসলি হলেও খুবই উর্বর, ফলে ফলন হয় ভাল। এখানকার বোরো ধান ও মাছ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। কিন্তু প্রতি বছর আগাম বন্যা কিংবা পানির অভাবে হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
নদী খনন ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, হাওরের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্তকরণ, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ এলাকাকে খুব সহজেই জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। হাওর রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ নেতা এডভোকেট ফরিদ আহমেদ বলেন, হাওরবাসী যে ধরনের জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থেকে দেশের উৎপাদন কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত রয়েছেন, এর কোন তুলনা নেই। ধান উৎপাদন ও মৎস্য আহরণসহ দেশবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে তাদের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। তাই হাওরবাসীর জন্য প্রতিটি সরকারেরই যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। এই করণীয়টুকু সঠিকভাবে করতে পারলে হাওরবাসীর উৎপাদনশীলতাও বহুগুণে বেড়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
Leave a Reply