ব্রিটেনে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন উদ্বেগজনক তথ্য। এ খবর দিয়েছে ব্রিটেনের অনলাইন টেলিগ্রাফ।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন নারী মেডিকেল শিক্ষার্থীর ৪ জনই যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
বিএমএ বলেছে, চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্লিনিকাল প্রশিক্ষণক্ষেত্রে একটি ‘লিঙ্গবৈষম্যমূলক ও অনিরাপদ সংস্কৃতি’ স্বাভাবিক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বিএমএ সতর্ক করেছে, এই সংস্কৃতি যদি পরিবর্তন না হয়, তবে ভবিষ্যতে এই শিক্ষার্থীরা যখন জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার (এনএইচএস) আওতায় হাসপাতালে কাজ করবেন, তখনও সমস্যাটি শিকড় গেড়ে বসবে।
প্রায় ১০০০ মেডিকেল শিক্ষার্থীর ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, নারী শিক্ষার্থীদের ৪১ শতাংশ ও পুরুষদের ১৯ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৮৫টি যৌন আক্রমণের ঘটনা, ৩৭টি ধর্ষণ বা জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, ৪৩টি ড্রিংক স্পাইকিংয়ের ঘটনা এবং ২৪টি অনুসরণ বা স্টকিংয়ের অভিযোগ।
প্রতিবেদনটি বলেছে, এই পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের মধ্যে বিশ্বাসের ভাঙন তৈরি করছে। যেসব শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, তাদের ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন- তারা তদন্তের ফলাফলে ‘একদমই সন্তুষ্ট নন’ বা ‘সন্তুষ্ট নন’।
অন্যদিকে, ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা মনে করেন না যে বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতের ঘটনাগুলি সঠিকভাবে মোকাবিলা করবে। ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো ঘটনা জানাতেই চাননি। কারণ তাদের বিশ্বাস- ‘কিছুই করা হবে না।
এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলার’ কারণে এক যৌন শিকারী ছাত্রকে আবারও তার কোর্সে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল পুলিশের কাছে না যেতে। কারণ এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এক সহপাঠী আমাকে এক রাতে অনুমতি ছাড়াই অশালীনভাবে স্পর্শ করে। আমি এতটাই আতঙ্কিত ছিলাম যে কিছু বলতে পারিনি, কেঁদে ফেলেছিলাম। পরে বলা হয়, যদি আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিষয়টি জানাই কিন্তু অপরাধীর নাম না বলি, তবে তা আমার ‘পেশাদার আচরণ’-এর ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে।
ফলে আমি এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম যেখানে আবারও আমাকে আমার নিপীড়কের সঙ্গে ক্লাস করতে হয়েছে। ক্লিনিকাল প্রশিক্ষণ চলাকালেও অনেকে রোগীদের কাছ থেকে যৌন মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।
একজন বলেন, এক পুরুষ রোগী বলেছিল ‘কী সৌভাগ্য আমার, তিনজন সুন্দরী মেয়ে হাঁটু গেড়ে আমার পাশে।’ আমরা সবাই খুবই অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। কিন্তু পাশে থাকা চিকিৎসক কিছুই বলেননি। শুধু বিব্রতভাবে হেসে ফেলেন। মনে হচ্ছিল, যেন এটাই স্বাভাবিক, আর প্রতিবাদ করলেই সেটা ‘অপেশাদার’ আচরণ বলে গণ্য হবে।
আরেক শিক্ষার্থী জানান, এই অভিজ্ঞতার পর তিনি এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে একা বাইরে যেতেও ভয় পেতেন এবং গভীরভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
জরিপে অংশ নেয়া ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, চিকিৎসা শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য একটি বড় সমস্যা।
একজন লিখেছেন, আমাকে সার্জারির পরিবর্তে জেনারেল প্র্যাকটিসে যেতে বলা হয়েছিল। কারণ এটা ‘মেয়েদের জন্য ভালো’, তারা ভবিষ্যতে সন্তান নিলে কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারবে।
ড. বেকি কক্স ‘সারভাইভিং ইন স্ক্রাবস’ নামে চিকিৎসাক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নবিরোধী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলেন, এই তথ্য ভয়াবহ। বৃটেনের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌন সহিংসতার মাত্রা কতটা গভীরভাবে প্রোথিত, তা এ থেকেই স্পষ্ট। মেডিকেল স্কুল ও এনএইচএস উভয়ই শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এ সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. চেলসি জেউইট বলেন, আমরা সব চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আহ্বান জানাই- মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ওপর নারীবিদ্বেষ ও যৌন সহিংসতা বন্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন। তাদের উচিত বেঁচে যাওয়া ভুক্তভোগীদের জন্য বিশেষ সহায়তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমে যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ করা।
বিএমএ’রর প্রতিনিধি এরিন ম্যাকক্যাব বলেন, এই ফলাফল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তবে দুঃখজনকভাবে শত শত মেডিকেল শিক্ষার্থীর কাছে তা কোনো বিস্ময় নয়। আমরা কৃতজ্ঞ সেই সাহসী শিক্ষার্থীদের কাছে, যারা এগিয়ে এসে নিজেদের গল্প শেয়ার করেছেন। তাদের সাহসই প্রকাশ করেছে এমন এক সংস্কৃতি, যার কোনো স্থান থাকা উচিত নয় বিশ্ববিদ্যালয়, এনএইচএস কিংবা সমাজের কোথাও।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আহ্বান জানিয়েছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আইনি দায়িত্ব আরোপ করতে হবে, যৌন সহিংসতার কঠোর ও একক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং মেডিকেল স্কুলগুলোর মধ্যে সমন্বিতভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
Leave a Reply