জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে অনেক বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রচারণা। এছাড়া স্বল্প সময়ে ভোটকেন্দ্র বাড়ানো, ব্যালট প্রস্তুত, লোকবল বাড়ানোর বিষয় তো আছেই। এমনটাই মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা নানান প্রতীকে প্রচারণা চালান। ফলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার আবহ তৈরি হয়। তবে গণভোট নিয়ে প্রার্থীদের তেমন কোনো স্বার্থ থাকে না। তাই এ দায়িত্ব সরকারকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়। ফলে গণভোট কতটুকু সাড়া ফেলতে পারবে তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায় বলে দাবি নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের।
চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অসম্ভব না
একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ, তবে অসম্ভব না জানিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ইসির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের। কারণ ইসি জাতীয় ভোটের রোডম্যাপ তৈরি করে এগিয়েছে। মাঝখানে গণভোটের সিদ্ধান্ত। এখন রোডম্যাপে পরিবর্তন আনতে হবে।’
গণভোটে বড় চ্যালেঞ্জ প্রচার-প্রচারণা। রাজনৈতিক দলগুলোকে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য ক্যাম্পেইন করতে হবে। দুটি নির্বাচন করছে সরকার। দলগুলো দুই রকমের ক্যাম্পেইন করবে- গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন।- নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম
তিনি বলেন, সরকার থেকে প্রয়োজনে লিখিত নির্দেশনা পেলে ইসি কাজ শুরু করবে। হাতে সময় কম, কাজটা দ্রুত করতে হবে। ইসির ডেডিকেটেড লোকদের দিয়ে করতে হবে। এটা চ্যালেঞ্জিং। কারণ দুটি বক্স লাগবে, দুটি ভোটকেন্দ্র লাগবে। গণনার জন্য আলাদা লোক লাগবে। সিল ও ব্যালট পেপার ডাবল লাগবে। বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অসম্ভব না।
গণভোটে বড় চ্যালেঞ্জ ক্যাম্পেইন দাবি করে ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘গণভোটে বড় চ্যালেঞ্জ প্রচার-প্রচারণা। রাজনৈতিক দলগুলোকে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য ক্যাম্পেইন করতে হবে। দুটি নির্বাচন করছে সরকার। দলগুলো দুই রকমের ক্যাম্পেইন করবে- গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন। তবে এটা শুরু হয়েছে। এক্ষত্রে রাজননৈতিক দলকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এজন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এসব প্রশ্ন নিয়ে আগ্রাসী প্রচার চালাতে হবে। বিশেষ করে নিরক্ষরদের জন্য পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বললে কী হবে, আর ‘না’ বললে কী হবে—সে সম্পর্কে বোঝাতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৩৪ বছর পর আরেকটি গণভোট হচ্ছে, যা বাংলাদেশে প্রথম। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি গণভোটের প্রচারণা, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে ভোটকক্ষ বাড়ানো, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর ভোটার সংখ্যা অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ সরঞ্জাম বাড়াতে হবে গণভোটে।
প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের বিষয়টিও রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে ব্যাপক প্রচার থাকবে প্রার্থীদের। আর গণভোট নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর বিষয় রয়েছে। এছাড়া একই দিনে জাতীয় ও গণভোট হলে ব্যয়ও ২০ শতাংশের বেশি বাড়বে। দেশের প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের সঙ্গে প্রবাসের লাখ দশেক ভোটার নিয়ে এ নির্বাচন হবে।
ব্যয় কমানোর জন্যই একই দিনে দুই ভোট
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রচারণার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব নিতে হবে। প্রার্থীরা যখন নিজেদের প্রতীকের জন্য ভোট চাইবেন, ডোর টু ডোর যাবেন, তখন ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করলে গুরুত্ব পাবে। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলে ভোটাররা আগ্রহ হারাবে। সরকার ও দলগুলোকে একসঙ্গে প্রচার করতে হবে।’
যেটা হবে গণভোট করতে গেলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ খরচ বাড়তি লাগবে। ব্যয় কমানোর জন্যই একই দিনে দুটি ভোট করা হচ্ছে।- ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী
তিনি বলেন, ইসির জন্য বড় দুটি নির্বাচন একদিনে হয়নি। প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটার। ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে। ভোটকক্ষও বাড়াতে হবে। ভোট দিতে সময় লাগবে। গণনাকারী দুই রকম লাগবে। একদল জাতীয় ভোট গণনা করবে, অন্যদল গণভোট। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একই দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যাবে।
গণভোট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি ও বিধি প্রণয়ণের পরই সার্বিক বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যাবে। এবার সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রায় দুই হাজার ৮শ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। গণভোট একসঙ্গে করলে ব্যয় সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেসমিন টুলী বলেন, যেটা হবে গণভোট করতে গেলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ খরচ বাড়তি লাগবে। ব্যয় কমানোর জন্যই একই দিনে দুটি ভোট করা হচ্ছে। একই দিনে সংসদ ও গণভোট হলে তার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি যেমন রয়েছে, তেমনি গণনার ক্ষেত্রে কোনটি আগে, কীভাবে করবে, তা নির্ধারণের বিষয়ও রয়েছে। আর গণভোটের ফলাফল গণনার সময় লাগবে বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চারটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। ভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটি মাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণ তাদের মতামত জানাবে।
তবে ব্যালটে চারটি বিষয় উল্লেখ থাকায় এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলাই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেজন্য গণভোটের বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার পরামর্শ দেন তারা।
একাধিক ইস্যুতে গণভোট হওয়ায় তার লক্ষ্য অর্জন কঠিন হতে পারে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করে তোলাই সরকার ও ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন সফল করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানোর পাশাপাশি গণভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভালো প্রশিক্ষণের বিষয় রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।-জেসমিন টুলী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, গণভোটের জন্য চারটি বিষয় রাখা হয়েছে। এতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং লক্ষ্য অর্জন কঠিন হতে পারে।
কারণ, সাধারণত একাধিক বিষয়ে বা একাধিক প্রশ্নে গণভোট হয় না। সেজন্য এসব বিষয় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। সময় স্বল্পতার কারণে এটা ইসির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
দ্বিগুণ কর্মযজ্ঞের ভোট
ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। সংসদ নির্বাচনের জন্য পৌনে ১৩ কোটি ভোটার ও প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার বিবেচনায় রেখে ব্যালট পেপার মুদ্রণের পরিকল্পনা চলছে। ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রায় দুই লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষ থাকবে। ৯ থেকে ১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাত থেকে আট লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন ভোটে।
ইসির নির্দেশনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ৩০০ আসনে সার্বিক নির্বাচন পরিচালনা করা হয়। তবে এখন গণভোটের জন্য হঠাৎ করেই বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হবে ইসিকে।
গণনায় ঢের সময় লাগবে
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ‘একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন সফল করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানোর পাশাপাশি গণভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভালো প্রশিক্ষণের বিষয় রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।’
১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোটে দায়িত্ব পালন করেছেন জেসমিন টুলী। তিনি বলেন, ‘ব্যালট পেপার গণনার সময় দুই সেট লোকবল লাগবে। এক সেট সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা করবে, আরেক সেট ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ ভোট গণনা করবেন।’
অনেক ভোটার বা বয়স্ক ব্যক্তি প্রতীক চিনতে পারলেও ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ কীভাবে শনাক্ত করবেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে ‘হ্যাঁ’ হলে টিক চিহ্ন এবং ‘না’ হলে ক্রস চিহ্নের ব্যবস্থা থাকবে। সুতরাং, কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। গণভোটের ব্যালট পেপার কীভাবে ইস্যু করবে, যারা গণনা করবে, তারা কীভাবে করবে সে বিষয়গুলো আছে।’
ফেব্রুয়ারিতে দিন ছোট হওয়ায় ভোটের সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার পরে ঝুঁকি রয়েছে। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে সকাল ৮টা বিকেল ৪টায় হয়ে যাবে। বয়োবৃদ্ধদের একটু সময় লাগে। ব্যালট বাক্স যেহেতু আলাদা হবে।’
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বাড়ানো ও সক্ষমতা বাড়ানো গেলে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না বলে মনে করেন জেসমিন টুলী।
গণভোটে যে ৪ প্রশ্ন থাকবে
চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণ মতামত জানাবেন। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে আগামী সংসদ হবে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) ১০০ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।
চারটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া গণভোটের ব্যালটে কোন ধরনের প্রশ্ন থাকছে—এ নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) বেলা ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি প্রশ্ন প্রকাশ করা হয়।
‘জুলাই সনদের আলোকে গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্নে’ উল্লেখ করে বলা হয়, আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?
ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধীদল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
Leave a Reply