শীর্ষবিন্দু নিউজ: চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য কেনা হচ্ছে ২৯টি কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং ইক্যুইপম্যান্ট। এসব যন্ত্র পরিদর্শনে পোল্যান্ড গেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানসহ চার সদস্যের একটি দল। দলের বাকি তিন সদস্য হলেন- প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) খায়রুল মোস্তফা, পরিচালক (প্রশাসন) ও ভারপ্রাপ্ত সচিব মুহিবুল হক এবং নির্বাহি প্রকৌশলী অভিজিৎ।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে পণ্য পরিদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পরিদর্শন সংস্থা রয়েছে। আবার বিদেশ থেকে কেনা পণ্য বন্দরে আসার পর পরিদর্শন করেই পণ্য বুঝে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এমন ব্যবস্থা থাকার পরও ক্রয়কৃত পণ্য পরিদর্শনে বিদেশ সফরের বিষয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০১২ সালে দরপত্রের মাধ্যমে ১০ টি পাঁচ টন ক্ষমতার লো-মাস্ট ফর্কলিফট যন্ত্র সরবরাহ করে কোরিয়ার দাইয়ু ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন। এসব যন্ত্র পরিদর্শনের জন্য কোরিয়া সফর করেন বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম এবং সহকারী প্রকৌশলী আসিফ মাহমুদ।
পরিদর্শন শেষে তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সন্তোষজনক অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে এসব যন্ত্রপাতি বন্দরে আসার পর গরমিল খুঁজে পায় অন্য এক কমিটি। যন্ত্রগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে নামানোর পর পরিদর্শন করেন প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) খায়রুল মোস্তফার নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি। এই কমিটি চারটি গরমিল খুঁজে পায়।
এছাড়া ২০১০ সালে তুরস্কে বর্জ্য অপসারণের জাহাজ পরিদর্শনে সাতটি ত্রুটি চিহ্নিত করে সফরকারী বন্দর কর্মকর্তারা। এসব ত্রুটি দূর করে জাহাজটি বন্দরে আনার সুপারিশ করে ওই কমিটি। তবে এসব ত্রুটি দূর না করেই জাহাজটি দেশে আনা হয়। এখনও জাহাজটি দিয়ে বর্জ্য অপসারণের কাজ পুরোপুরি করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র মতে, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের খচড়া নীতিমালা অনুযায়ী এরকম সফরে পরিচালক প্রশাসন মুহিবুল হক যেতে পারেন না। এছাড়া ওই নীতিমালায় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বিদেশ সফরে বন্দর চেয়ারম্যানকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে চার সদস্যের এ দলে নীতিমালা অনুযায়ী কেবল দুইজন কর্মকর্তা সফরে যেতে পারেন। নীতিমালায় বলা হয়েছে যন্ত্র ক্রয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ছাড়া অন্য কোন বিভাগের কর্মকর্তা বিদেশ সফর করতে পারবেন না। এছাড়া একই কর্মকর্তার একাধিকবার বিদেশ সফরকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
নীতিমালা অনুসরণ না করে এর আগেও একাধিকবার বিদেশ সফর করেছেন বন্দরের কর্মকর্তারা। আর তাই বরাবরের মতো এবারো বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতিসহ পণ্য ক্রয়ে বন্দর কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সফরের খবচ বহন করার কারণে বেড়ে যায় যন্ত্রের দাম। যন্ত্রপাতি কেনার সঙ্গে কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও বিদেশে সফরসঙ্গী হচ্ছেন অনেকে। বিদেশ সফর থেকে ফিরে সন্তোষজনক প্রতিবেদন দেওয়া হলেও বন্দরে আসার পর কেনাকাটায় ধরা পড়ছে গড়মিলও।
বন্দরের হিসাবে দেখা গেছে, কেনাকাটা বাবদ গত ১৭ মাসে ৩৩ টি দল বিদেশ সফরে গেছেন। এসব দলের বিদেশে কেটেছে মোট ১৮১ দিন। প্রতিটি দলে ন্যূনতম দুই থেকে সর্বোচ্চ সাতজন কর্মকর্তা সফর করেছেন। সফরকারী দলের মোট সদস্য ছিলেন ৯৭ জন। তবে একই কর্মকর্তা ন্যূনতম এক থেকে সাতবার পর্যন্ত বিদেশ সফর করেছেন। এ হিসেবে ৬৩ জন কর্মকর্তা এক বা একাধিকবার বিদেশ সফর করেন।
পোল্যান্ড সফরের কোর্ডিনেটর খায়রুল মোস্তফা জানান, শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রোববার দুপুরে পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন। আগামী ১৫ মার্চ দেশে ফিরবেন তারা। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি তিনি। নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালক (প্রশাসন) মুহিবুল হক যন্ত্র ক্রয়ে বিদেশ সফরে যাওয়ার নিয়ম না থাকলেও বন্দরের কাজে বিদেশ যাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার মুহিবুল হক বাংলানিউজকে বলেন, সফরে যাচ্ছি না। বন্দরের কাজে যাচ্ছি।
বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও পণ্য ক্রয়ের সময় দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, যন্ত্রপাতি দেশে আনার আগে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের খরচে বন্দর কর্মকর্তাদের প্রাক জাহাজীকরণ পরিদর্শনে(প্রি শিপম্যান্ট ইন্সপেকশান) নিয়ে যেতে হবে। ঠিকাদাররা দরপত্র জমা দেওয়ার সময় এই খরচ বিবেচনায় নিয়েই যন্ত্রপাতির দাম জমা দেন। এতে যন্ত্রপাতি কেনাবাবদ খরচ বেড়ে যায়। গত ১৬ মাসে ১৪ টি বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যন্ত্রপাতির খরচের সঙ্গে বিদেশ সফরের খরচ যোগ করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হয়। নিয়মানুযায়ী, বন্দর কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা অর্জন ও প্রশিক্ষণের কাজে বিদেশ সফরের জন্য বরাদ্দ থাকে। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই খাতে খরচ হয় এক কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজেট ছিল এক কোটি ৮৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই কোটি টাকা। প্রশিক্ষণের কাজে বিদেশে যাওয়ার খরচ জানা থাকলেও যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে বিদেশ সফরের খরচ অস্বচ্ছ থেকে যাচ্ছে।