মতিউর রহমান চৌধুরী |
২৯শে জুন। ১৯৮৬ সাল। স্থানীয় সময় দুপুর বারোটা। মেক্সিকোর বিখ্যাত আজটেকা স্টেডিয়াম। প্রচ- গরম বাইরে। অনেকেরই হয়তো স্মরণ আছে গরমের কারণে মেক্সিকোতে ৭০’র বিশ্বকাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফিফা অনেক দৌড়ঝাঁপ করে টুর্নামেন্টকে বাঁচিয়েছিল।
এবারও সেই পুরনো বিতর্ক জারি করেছিল ইউরোপীয় টিমগুলো। গরমের কারণে ‘কুলিং ব্রেক’ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে চালু হয়। যা-ই হোক, এই গরম উপেক্ষা করে ১ লাখ ১৪ হাজার ৬শ’ জন ফুটবল ভক্ত হাজির। বাইরে আরও অন্তত হাজার দশেক মানুষ। যাদের হাতে টিকিট নেই। অল্প দূরে বিশাল বিশাল স্ক্রিনে খেলা দেখার ব্যবস্থা। শহরময় মানুষজন কিলবিল করছে। বিশ্বকাপের ফাইনাল বলে কথা। যদিও মেক্সিকো নেই। তাতে কি? ল্যাটিন শক্তি আর্জেন্টিনা তো রয়েছে। লড়াইটা হচ্ছে পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাপী টানটান উত্তেজনা। কে জিতবে- আর্জেন্টিনা না জার্মানি।
আরও বড় প্রশ্ন ম্যারাডোনাকে নিয়ে। তিনি কি পারবেন জার্মান দুর্গ ভেঙে চুরমার করে দিতে। জার্মান কোচ ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার কি পারবেন ম্যারাডোনার গতি স্তব্ধ করতে। ম্যারাডোনা তখন অপ্রতিরোধ্য। কেউ তাকে আটকাতে পারে না। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড শত কৌশল করেও তাকে রুখতে পারেনি। ববি রবসন খেলা শেষে বলেছেন, মানলাম ম্যারাডোনা হাত দিয়ে গোল দিয়েছে। ফলাফল তো আমাদের পক্ষে ছিল না। ও তো আমাদের বিরুদ্ধে দু’টি গোল করেছে। দ্বিতীয় গোলটি অসাধারণ। বিশ্বকাপে স্মরণীয়। বলাবলি হতে পারে ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়ে গোল না করলে ফলাফল অন্য হতে পারতো।
কিন্তু এটা তো ভুললে চলবে না তিউনিসিয়ার রেফারি গোলের বাঁশি বাজিয়েছিলেন। রেফারির সিদ্ধান্ত এখানে চূড়ান্ত। যদিও বৃটিশ প্রেস এখনও ম্যারাডোনাকে ক্ষমা করেনি। ম্যারাডোনা নিজে বলেছেন, ওটা ছিল বৈধ গোল। তবে তিনি যে হাত দিয়ে রেফারিকে ফাঁকি দিয়ে গোল করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। ফুটবল যতদিন থাকবে ততদিন এই বিতর্ক থাকবেই। টেলিভিশনে স্ল্লো মোশনে যখন আমরা রিপ্লে দেখি, তখন আমাদের সামনে এই প্রশ্ন থাকবেই। পুরনো ইতিহাসটা টানলাম এই কারণে আর্জেন্টিনার ছিল একজন ম্যারাডোনা।
এবার একজন মেসি। মেক্সিকো থেকে ব্রাজিল। আজটেকা স্টেডিয়াম নয় এবার মারাকানা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা-জার্মানি। বলা হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকায় কখনও ইউরোপের কোন দেশ বিশ্বকাপ জেতেনি। ইতিহাস তো মাঝে মধ্যেই বদলে যায়। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। কে জানতো জার্মানির সঙ্গে ব্রাজিল ৭-১ গোলে হেরে গিয়ে ফুটবল ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে। যে খেলা নিয়ে তামাম দুনিয়ায় গবেষণা হচ্ছে এবং হবে। কারণ এটা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। জার্মান কোচ জোয়াকিম লো কি কৌশল নেবেন।
এই মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একজন সফল কোচ। ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার যে কৌশল বেছে নিয়েছিলেন তাই নেন কিনা? ’৮৬-এর ফাইনালে তার মূল কৌশল ছিল এক ম্যারাডোনাকে আটকাতে পারলেই বিশ্বকাপ তার হাতে। কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছিল তার এই কৌশল। জার্মান মিডিয়া বলেছিল, এটা ছিল আত্মঘাতী এক কৌশল। ম্যারাডোনাকে আটকানো গেলেও গোল হজম করতে হয়েছে তিনটি। বেকেনবাওয়ার ম্যারাডোনাকে আটকাতে লুথার ম্যাথিউসকে মার্কার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সাজঘরে ম্যাথিউসকে বলেছিলেন, ম্যারাডোনাকে থামাতে চাই। তাই তুমি মিডফিল্ড ছেড়ে জোঁকের মতো লেগে থাকবে ম্যারাডোনার পেছনে। প্রয়োজনে ফাউলের আশ্রয়ও নেবে। লুথার ম্যাথিউস এমন একজন প্লেয়ার ছিলেন, যার খেলা এখনও চোখে ভাসে। ’৯০ বিশ্বকাপে জার্মানি তার হাত ধরেই ট্রফি জিতেছিল। ম্যাথিউস অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোচের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন।
পরে বলেছেন, এতে কোন ফায়দা হয়নি। ম্যারাডোনা নিজে হয়তো গোল পাননি। অন্যরা ঠিকই গোল বের করে নিয়ে গেছে। মাঝখানে আমি আমার স্বাভাবিক খেলাও খেলতে পারিনি। জার্মান প্রেস পরে প্রচ- সমালোচনা করেছিল ফুটবল তারকা কাম কোচ ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ারের। মজার ব্যাপার হচ্ছে আর্জেন্টিনা প্রথম গোল পেয়েছিল ম্যাথিউসের ফাউল থেকে। কোচের নির্দেশমতো ম্যারাডোনাকে ফাউল করেন লুথার ম্যাথিউস। মাঝমাঠ থেকে একটি বল নিয়ে ম্যারাডোনা ড্রিবলিং করে সামনে যাচ্ছিলেন। তাকে আটকানো যাচ্ছিল না। ম্যাথিউস অবৈধভাবে তাকে ফেলে দেন। খেলার ২২ মিনিটে ঘটেছিল এই ঘটনা। ম্যারাডোনার বিকল্প যাকে ভাবা হতো সেই বুরুচাগা ফ্রি কিক নেন। জার্মান গোলরক্ষক শুমাখার ভেবেছিলেন বলটি ক্লিয়ার হয়ে গেছে।
কিন্তু মুহূর্তেই বল চলে আসে ব্রাউনের কাছে। অনেকটা বিনা বাধায় ব্রাউন হেড করে বল পাঠিয়ে দেন নেটে। আর্জেন্টিনার উল্লাস দেখে কে? ম্যারাডোনা তো লাফাচ্ছিলেন। খেলার গতি তখন থেমে গেছে। বেকেনবাওয়ার লেফট উইঙ্গার অ্যালফসকে বসিয়ে রুডি ফোলারকে মাঠে নামান। উদ্দেশ্য, খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া। কাজের কাজ কিছুই হলো না। জার্মান ডিফেন্সকে আননার্ভ করে দিয়েছে ম্যারাডোনা বাহিনী। খুব সহজেই বল নিয়ে যাচ্ছে ডি বক্সের কাছাকাছি। এই যখন অবস্থা ৫৬ মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে ভালদানো গোল পেয়ে যান। ২-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। বেঞ্চে বসা বেকেনবাওয়ার এখন কি করবেন।
আবার প্লেয়ার পরিবর্তন। এবার মিডফিল্ডার ম্যাগানকে উঠিয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ড হোয়েসেনকে নামালেন। গোলের আশায় বেকেনবাওয়ারের মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে। প্রথমার্ধে গোল পেলো না জার্মানি। দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানি অ্যাটাকিং ফুটবল খেলতে থাকলো। ২৮ মিনিটে একটি কর্নার শট থেকে রুমেনিগো গোল পেয়ে গেলেন। আর্জেন্টিনা তখনও ভাবছে খেলার ফলাফল তাদের পক্ষেই থাকবে। ফুটবল তো। খেলা শেষ হওয়ার ৮ মিনিট আগে কর্নার পেয়ে যায় জার্মানি। অনেকটা নাটকীয়ভাবে রুডি ভোলার খেলায় সমতা আনেন। তীব্র উত্তেজনা মাঠে। গ্যালারিও কাঁপছে।
মেক্সিকানরা ‘ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা’ বলে চিৎকার করছেন। আর বলছেন, এবার দেখা যাক কি হয়। সবার দৃষ্টি ম্যারাডোনার দিকে। মাত্র দু’মিনিট পরে সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ম্যারাডোনা কোন অবস্থাতেই খেলাটি ১২০ মিনিটে কিংবা ঘাতক পেনাল্টি শুটআউটে নিতে চাননি। তাই তিনি জাদুকরি ভূমিকায় নামলেন। বাঁ পায়ের কসরত দেখলো দুনিয়া। জার্মানির দু’জন প্লেয়ারকে কাটিয়ে নিখুঁত একটি পাস বাড়িয়ে দিলেন। যে পাস থেকে খেলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন। গোলটি করেছিলেন বুরুচাগা। বিশ্বব্যাপী নাম ছড়িয়ে গেল ম্যারাডোনার। অনেকটা একক প্রচেষ্টায় বিশ্বকাপ বিজয়ী ম্যারাডোনাকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল ফুটবল বিশ্বে। এবার প্রায় সে রকমই এক পরিস্থিতি। ম্যারাডোনার জায়গায় মেসি। তাকেও আটকানো বড় কঠিন। জীবনের শেষ সুযোগই বলা চলে। তিনি কি জ্বলে উঠবেন।
ল্যাটিন আমেরিকা কেন, বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি ফুটবল ভক্ত মেসির হাতে ট্রফি দেখতে চান। চাইলেই তো আর হবে না। টিমটা জার্মানি। এক জ্বলন্ত শক্তি। শুধু জ্বলে, নিভে খুব কম। তাছাড়া দলটিতে রয়েছেন টমাস মুলার। যিনি যে কোন স্থান থেকে গোল করতে পারদর্শী। মাত্র ক’দিন আগে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। লজ্জায় ফেলেছেন ফুটবল দুনিয়াকে। ফাইনালে এমন খেলার সাক্ষী আমরা আর হবো কিনা কে জানে। ’৮৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিল পেনাল্টি শুট আউটে ফ্রান্সের কাছে হেরে গিয়ে বিদায় নিয়েছিল। তারকা ফুটবলার জিকো পেনাল্টি মিস করেছিলেন। পেনাল্টি মিসে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতালির রবার্তো ব্যাজিও মিস করেছিলেন ’৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী হিসাব নিকাশ হচ্ছে অন্যভাবে।
একদিকে মেসি, অন্যদিকে জার্মান গোল মেশিন। এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে গণনায়ই নেয়া হয়নি। বলা হয়েছিল ব্রাজিল অপ্রতিরোধ্য। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ২৯ খেলায় হারেনি। তাছাড়া নিজের মাঠে খেলা। বাড়তি সুবিধা তো আছেই। কিন্তু ফুটবলের বড় বড় শক্তি দুর্বল প্রতিপক্ষের মাঠেই হেরেছে বেশি। আর্জেন্টিনার রক্ষণ ও গোলকিপিং নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। অথচ দেখা গেল এই দু’টি বিভাগই জ্বলেছে বেশি। গোলকিপার রোমেরিও হল্যান্ডের বিশ্বকাপ স্বপ্নের ইতি টেনে দেন দু’টো পেনাল্টি শট আটকিয়ে। নেইমার বলেন, রোনালদিনহো বলেন, সবাই এগিয়ে রাখছেন আর্জেন্টিনাকে। মেসিকে থামানো সম্ভব নয়, এটাও বলছেন। বাড়তি শক্তি হচ্ছেন পোপ। ভ্যাটিকান সিটিতে বসে তিনি প্রার্থনা করছেন, হে ঈশ্বর তুমি আমার দেশের দিকে তাকাও।
আর্জেন্টাইন পোপের ছবি মারাকানা স্টেডিয়ামের চারপাশে শোভা পাচ্ছে- এই খবর এলো সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। অবশ্য নীল জার্সির প্রতি আর্জেন্টাইনদের এক ধরনের ভীতি রয়েছে। ফাইনালে তাদেরকে নীল জার্সি পরতে হবে। এই জার্সিতে তারা একবারও জার্মানদের বিরুদ্ধে জয় পায়নি। ১৯৯০ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ২০০২ বিশ্বকাপে সুইডেনের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল। যা-ই হোক, মেসিকে আটকাতে কি কৌশল নেন জোয়াকিম লো তা দেখার বিষয়।
টিম জার্মানি আত্মবিশ্বাসের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। মুলার, ক্লোসার গতিরোধ করা যাচ্ছে না। বল যেখানে তারাও সেখানে। আবেগের দিক থেকে অনেক এগিয়ে আর্জেন্টিনা। মাঠভর্তি দর্শক তো গগনবিদারী স্ল্লোগানে মাতিয়ে রাখবেন। মেসি মেসি বলে কোরাস গাইবেন। ম্যারাডোনাকে আটকাতে গিয়ে যে ভুল ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার করেছিলেন সে রকম কিছু করেন কিনা। মেসিকে নিয়ে বন্দনা হচ্ছে দুনিয়ায়। মেশিন গান নিয়ে তাড়া করবেন নাকি কাটা রাইফেল হয়েই থাকবেন তা-ই দেখার বিষয়।
শেষ কথা হচ্ছে, ফুটবলে কোনটাই নিশ্চিত করে বলা যায় না। কে জানতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিতে হবে। ব্রাজিলের কথাই ভাবুন। যে দলে মেসির মতো জাদুকর রয়েছেন সেখানে বাজি ধরাও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বাজি ধরবেন না। হেরে যেতে পারেন। গত তিনটি ম্যাচে আর্জেন্টিনার ডিফেন্স প্রমাণ করেছে তাদের প্রাচীর ভেদ করা সত্যি কঠিন। হল্যান্ড তারকা রোবেন বলছেন, কোথা থেকে মাসচেরানো এসে বলটি ক্লিয়ার করলো তা বুঝতেই পারলাম না। না হলে অন্য ইতিহাস হতো।
ফিফার অফিসিয়েল বল ব্রাজুকা। মারাকানার ঐতিহাসিক ফাইনালের বলের ওপর লেজার প্রিন্ট করে খেলার তারিখ, স্টেডিয়াম ও দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম লিখে রেখেছে। লেখেনি কে পাবে বিশ্ব ফুটবলের তকমা। সেটা লেখার সুযোগ নেই। মারাকানা স্টেডিয়াম থেকেই কেবল সে ঘোষণা আসতে পারে। ইতালির রেফারি নিকোলা রিজোলি শেষ বাঁশিটা কিভাবে বাজান তার জন্য অপেক্ষা করুন। দেখুন কি হয়। অত্যধিক চাপ নেবেন না। শরীর খারাপ হয়ে যাবে।