নওশাদ জামিল: মাথায় সাদা চুল। চোখে ভারী চশমা। একটু পর পর চশমা খুলে চোখ মুছছিলেন- তিনি ভাস্কর রশীদ আহমেদ। চশমার ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছিল চিকচিকে অশ্রুবিন্দু। বয়স হয়েছে ঢের, ৭৮ বছর। বয়সের ভারে ক্লান্ত তিনি। আর এ বয়সেই কিনা শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের এই ভাস্কর কি ভুলতে পারবেন ভারতে আট বছর কারাভোগের মর্মন্তুদ দিনগুলোর কথা? ‘আট বছর বিনা বিচারে জেলে কাটিয়েছি। বৃদ্ধ বয়সে কত নির্যাতনই না সইতে হয়েছে জেলজীবনে! বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভারতের জেলে মরলেও লাশটা যেন বাংলাদেশে পাঠানো হয়- নিরুপায় হয়ে এ আবেদনও করেছিলাম ভারত সরকারের কাছে। অনেক যন্ত্রণার পর বেঁচে ফিরেছি দেশের মাটিতে। তবু কারাভোগের এই দিনগুলো কী করে ভুলব, বাবা!’ কথাগুলো বলতে বলতে আবারও চোখ মোছেন রশীদ আহমেদ।
নিভৃতচারী ভাস্কর রশীদ আহমেদ ও তাঁর পুত্রবধূ নূরুন নাহার ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে দিল্লির তিহার কারাগারে আটক ছিলেন। গত শুক্রবার মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছেন তাঁরা।
আবেগমথিত কণ্ঠে ভাস্কর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০০৪ সালে ভারতে গিয়েছিলাম আজমির শরিফ জিয়ারত করতে। দুই ছেলে আর দুই মেয়ের সাজানো সংসার। হাতে ছিল কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ। সব মিলিয়ে সুখেই ছিলাম। আট বছর পর দেশে ফিরে দেখি কিছুই নেই। কয়েকটা জামাকাপড় আর কয়েক টুকরো কাগজ- এই এখন আমার সম্পত্তি।’
গতকাল বুধবার দুপুরে এভাবেই নিজের নিঃস্বতার কথা, অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন ভাস্কর রশীদ আহমেদ। সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানান তিনি, ‘আমার এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই। মামলা চালাতে গিয়ে বেচতে হয়েছে মাদারটেকের বাড়ি। রয়েছে ঋণের বোঝা। পকেটে কোনো টাকাপয়সাও নেই। এক কাপ চা খেতে হলেও মেয়ের কাছে হাত পাততে হয়।’ দেশে ফেরার পাঁচ দিন পার হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানান তিনি।
বিনা বিচারে সাত বছর ১১ মাস ভারতের কারাগারে কাটানোর পর গত ঈদের দিন পুত্রবধূ নূরুন নাহার লাভলিকে নিয়ে দেশে ফেরেন রশীদ আহমেদ। আট বছরের দুর্বিষহ জীবন, দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয় নিয়ে দিলকুশায় চাচাতো ভাই এ এইচ খানের অফিসে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছোট মেয়ে লিপি আহমেদ।
১৯৬১ সালে চারুকলা মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে পাস করেন রশীদ আহমেদ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র সেতুর কাছের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিভাস্কর্যসহ মুক্তিযুদ্ধের ওপর বেশ কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন তিনি। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লির পাহাড়গঞ্জের একটি আবাসিক হোটেল থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই হোটেলের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে তাঁদের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়। এরপর ব্যবস্থাপকের নির্দেশে কিছু লোক এসে জাল নোট পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে হোটেল থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে যায়। পরে জানা যায়, ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে। পরে সিবিআই জাল টাকা পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করে। তাঁদের দিল্লির কুখ্যাত তিহার কারাগারে পাঠায়। এরপর মামলাটি শুধু তারিখ দেওয়া না দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া অন্য দুই ভারতীয়কে দুই বছর পর মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁদের মুক্তির বিষয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন আদালত। সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যম, বিশেষ করে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদক ইন্দ্রানী বসু ও দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কনস্যুলার মিনিস্টার নজিবুর রহমানের কার্যকর ভূমিকায় তাঁদের মামলা সচল হয়। বিচারে তাঁদের সাত বছরের কারাদণ্ড এবং দেড় লাখ রুপি জরিমানা অনাদায়ে আরো দেড় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে প্রায় আট বছর কারাভোগ করতে হয়েছে তাঁদের; জরিমানাও দিতে হয়েছে। সাজা খাটা হয়ে গেছে- এ বিবেচনায় আদালত তাঁদের মুক্তির আদেশ দেন।
আলাপচারিতার শুরুতেই ভাস্কর রশীদ আহমেদ জানান তিহার কারাগারে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ‘বাইরের বিশ্ব থেকে পুরোপুরি আলাদা ছিলাম। কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। টেলিফোন করা দূরের কথা, চিঠি লেখারও কোনো সুযোগ ছিল না। এমনকি অন্য বাঙালি কয়েদিদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতেও বাধা দিত কারারক্ষীরা। নানাভাবে আমি আমার পরিবার ও দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। মুক্তি পাওয়া কয়েদিদের অনুরোধ করে চিঠি পাঠাতাম।’
জেলের প্রথম দিনেই রশীদ আহমেদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ঝাড়ু। এ কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘যখন গ্রেপ্তার হই তখন আমার বয়স ছিল ৭০ বছর। জেলে ঢোকানোর পরেই আমার হাতে ঝাড়ু ও বাথরুম পরিষ্কারের সরঞ্জাম তুলে দেওয়া হয়। বয়সের ভারে ক্লান্ত হলেও আমার ওপর অত্যাচার কমেনি। আমাকে এমনভাবে আদালতে নেওয়া হতো, যেন আমি ভয়ংকর কোনো আসামি। যখন তখন তুই-তোকারি করে কথা বলা হতো। আমাকে জেলের লোকজন পুরো সময়টাই অপমান করেছে। আমি যে একজন সম্মানীয় ব্যক্তি, তা তারা কখনোই খেয়াল করেনি।’
রশীদ আহমেদ বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়ার তিন মাস পর আমার সঙ্গে হাইকমিশনের কনস্যুলার পদমর্যাদার একজন- তাঁর নাম আসাফুদৌলা- যোগাযোগ করেন। তিনি আমাকে মুক্তির ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েও কিছুই করেননি। এরপর আমি প্রায় দেড় ডজন চিঠি পাঠাই হাইকমিশনে। এতেও কিছু হয়নি। প্রায় আট বছর পরে গণমাধ্যমে বিষয়টি এলে সবার টনক নড়ে; গত মাসে মামলার রায় হয়।’ আলাপচারিতার একপর্যায়ে তাঁর মেয়ে লিপি আহমেদ বলেন, ‘হারানোর বেদনা অনেক বেশি তাঁর বাবার চেয়ে ভাবি নূরুন নাহারের। তাঁর বন্দি হওয়ার পরের বছর ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট একমাত্র মেয়ে ১৩ বছরের চাঁদনী মারা যায়। তাঁর ভাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। দেশে ফিরে এসব শুনে ভাবিও দিশেহারা; স্তব্ধ, নির্বাক।’
লিপি জানান, শারীরিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছেন তাঁর বাবা। গতকাল সকালে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন চেকআপের জন্য। অধ্যাপক ডা. মো. রেজাউল করিম তাঁকে বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে দিয়েছেন। তাঁর উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে। তাঁর হাঁটতেও বেশ কষ্ট হয় বলে জানালেন লিপি।
আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে জানতে চাওয়া হয় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। ম্লান হেসে ভাস্কর রশীদ বললেন, ‘বর্তমানই নেই, ভবিষ্যতের কথা কিভাবে বলব! তার পরও বলি, আমি আবারও ফিরে যেতে চাই আমার পেশায়। নির্মাণ করতে চাই মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য।’ কথাগুলো বলার সময় যেন মনে হলো ৭৮ বছরের কোনো বৃদ্ধ নন, ১৮ বছরের এক তরুণ জানাচ্ছেন তাঁর দীপ্ত অঙ্গীকারের কথা।
Leave a Reply