শামছুদ্দীন আহমেদ: বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট এ চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে হেফাজতে ইসলাম। বিশেষ করে, গত ৫ মে রাজধানীতে দিবাগত গভীর রাতের ‘শাপলা চত্বর অভিযান’-এর বেশ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে ভোটারদের মাঝে। এই প্রভাবের কারণে এক ধরনের বেকায়দা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে সরকারি জোট সমর্থক মেয়র প্রার্থীদের। আর ফলাফল অনুকূলে নিতে বিষয়টিকে কাজে লাগানোর সবরকম চেষ্টা করছেন বিরোধী জোট সমর্থিত মেয়র প্রতিদ্বন্দ্বীরা। আবার সরকারি জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরাও হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে এক্ষেত্রে তাদের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে, সাধারণ ভোটারদেরও অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে তাদের। আগামী ১৫ জুন অনুষ্ঠেয় এই চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের ভূমিকা এবং ‘শাপলা চত্বর অভিযান’-এর প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ করে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া হতাহতের ঘটনা বড় ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিটি সভা-সমাবেশে ৫ মে’র ঘটনা ফলাও করে উল্লেখ করছেন। কোনো কোনো স্থানে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা প্রকাশ্যেই ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে না পারলেও গোপনে সমর্থন যোগাচ্ছেন বিরোধী জোট সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা, যাদের প্রত্যেকেই সদ্য সাবেক মেয়র তারা নির্বাচনি প্রচারণায় নিজেদের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের পাশাপাশি সরকারের সাফল্যের ফিরিস্তি মেলে ধরছেন, বলছেন একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারকাজের পক্ষেও। এর বিপরীতে ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় গুরুত্ব দিচ্ছেন সদ্য সাবেক মেয়র ও সরকারের দুর্নীতি-অনিয়ম-ব্যর্থতার বিষয়কে, হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গভীর অন্ধকার রাতে যৌথ বাহিনীর চালানো অপারেশনে হতাহতের ঘটনাসহ অন্যান্য জাতীয় ইস্যুগুলোকেও তুলে ধরছেন সমান গুরুত্ব দিয়ে। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সক্রিয় ভূমিকা এবং শাপলা চত্বরের অভিযানের প্রভাব যে ভোটারদের মধ্যেও কাজ করছে, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরাও ওয়াকিবহাল। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা এবং ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের পক্ষে পোস্টার লাগাতে গিয়ে রাজশাহীতে ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের দুই কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের মতিঝিলের সমাবেশে গভীর রাতে হতাহতের বর্ণনা দিয়ে সেখানে নিয়মিত লিফলেট বিতরণ করছেন সংগঠনটির কর্মীরা। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এরইমধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের একজন অতিরিক্তি সচিবও বৃহস্পতিবার বলেছেন, নির্বাচনী প্রচারণায় হেফাজতের ইস্যুকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বরিশালে খবর নিয়ে জানা গেছে, ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থী শওকত হোসেন হিরন সমর্থন আদায়ে হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় আমিরের মাদ্রাসায় গেছেন, সম্পর্ক উন্নয়নে সেখানে তিনি খাওয়া-দাওয়াও করেছেন। হেফাজের আমির তাকে বলেছেন, উন্নয়নের বিষয়টিকে বিবেচনায় নেবেন তারা। তবে ভেতরের খবর ভিন্ন। হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা কার্যত ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের পক্ষে নীরবে কাজ করছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা তা সভা-সমাবেশে উল্লেখও করছেন। অবশ্য হেফাজতের নেতা-কর্মীরা এখনও প্রকাশ্যে কারও পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেননি। তবে ঢাকার ৫ মে’র ঘটনার বেশ প্রভাব আছে মুসলিম ভোটারদের মাঝে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ মনোভাবের অভিযোগও করছেন কেউ কেউ। সিলেটে বিএনপিসহ ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে মাঠে নামতে যাচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। জানা গেছে, সিদ্ধান্ত নিতে খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে আগামী ৩ জুন জেলা ও মহানগর কমিটির সভা ডাকা হয়েছে। সেখান থেকে সাংগঠনিকভাবে আরিফের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানেও আরিফের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে হেফাজতের স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মীকে উপস্থিত থাকতে দেখা যাচ্ছে। সূত্রমতে, হেফাজতের কিছু নেতা-কর্মীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন কামরানের ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। তবে ৫ মে’র ঘটনায় সে সম্পর্কে চিড় ধরেছে। সিলেটেও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঐ ঘটনায় বড় ধরনের সেন্টিমেন্ট কাজ করছে। রাজশাহীতে ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের পক্ষে কাজ করার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক হাফেজ আব্দুস সামাদ। এই ঘটনায় বুলবুলকে শুক্রবার কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ সরকার। তিনি বুলবুলের কাছে হেফাজতে ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। স্থানীয়ভাবে খবর নিয়ে জানা যায়, ৫ মে মতিঝিলের অভিযানের বেশ নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ভোটারদের মাঝে। তারা মনে করছেন, সরকার কাজটি ঠিক করেনি, ইসলাম ও মহানবীকে (সা.) অবমাননাকারী ব্লগারদের পক্ষ নিয়ে সরকার ভুল করেছে। অবশ্য স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার বিরুদ্ধেও নারী ভোটারদের একাংশের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীর মতো অভিন্ন চিত্র খুলনায়ও। পুলিশি হয়রানির ভয়ে হেফাজতের স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকরা প্রকাশ্যে না পারলেও ভেতরে-ভেতরে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকও হেফাজতের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে শাপলা চত্বর অভিযান নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ক্ষোভ অনুভূত হচ্ছে।
Leave a Reply