বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ০৭:০৩

ষোড়শী সুন্দরীর বেশে বহুরূপী ইমা

ষোড়শী সুন্দরীর বেশে বহুরূপী ইমা

 

 

 

 

 

 

 

 

নূরুজ্জামান: এক প্রেয়সীর বহুরূপে তছনছ হয়ে গেছে অনেক যুবকের সংসার। নিঃস্ব হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। বয়স তার ৩৮ ছুঁই ছুঁই। মেকআপ দিয়ে আড়াল করে বয়স ও বর্ণ। সেজে থাকে ষোড়শী সুন্দরীর বেশে। চলাচল করে এসি গাড়িতে। থাকে অভিজাত এলাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। কিছুদিন পরপরই বদল করে গাড়ি। বদল করে বাড়ি। আর টার্গেট করে নতুন নতুন ক্লায়েন্ট। কখনও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কখনও সরকারি কর্মকর্তা। নিজেকে উপস্থাপন করে ফ্যাশন ডিজাইনার ও ব্যবসায়ী হিসেবে। কখনও পরিচিত হয় মডেল ও নায়িকার ছদ্মবেশে। তার পদবির তালিকায় আরও আছে চিত্রনির্মাতা, ভিওআইপি, গাড়ি ব্যবসায়ী, আদম বেপারি ও মৎস্য খামারি। সুযোগ বুঝে বিনোদন পত্রিকার সম্পাদকও বনে যায় সে। শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে এইচএসসি পাস। কথা বলে ইংরেজিতে। তার নাম রেজওয়ানা খালেদ ইমা। একজন বহুরূপী প্রতারক। তার ছলনায় বিপথগামী হয়েছেন অনেক উদীয়মান চিত্রাভিনেতা। ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন বিত্তশালী। বাদ যাননি সহজ-সরল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন ডজনখানেক র‌্যাম্প মডেল।

গত শুক্রবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নিয়েছে। তার গ্রেপ্তারের খবর শুনে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ছেড়ে দেয়ার তদবির যেমন এসেছে, তেমনি অসংখ্য ভুক্তভোগী গোয়েন্দা পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পরে পুলিশের উচ্চপর্যায় ইমা’র অভিনব প্রতারণার কৌশল জেনে হতবাক হয়েছেন। তাকে ছেড়ে না দিয়ে উল্টো দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গতকাল ইমা অন্তত ৩০টি প্রতারণার কথা স্বীকার করেছে। বলেছে, তার প্রতারণা চক্রে তার ভাই, বাবা ও কয়েক ঘনিষ্ঠ সদস্য জড়িত। তাদের সহায়তায় সে এ পথে নেমেছে। উপার্জন করেছে কয়েক কোটি টাকা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, প্রতারণার অভিযোগে ইমার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। আরও একাধিক মামলা প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতারণার ঘটনায় ২০-২৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে। ইমা’র গ্রেপ্তারের খবর শুনে দেশ ও দেশের বাইরে বসবাসকারী অসংখ্য ভুক্তভোগী তার প্রতারণার নানা তথ্য সরবরাহ করেছে। ইতিমধ্যে চুয়াডাঙ্গা, চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকার কয়েক ব্যবসায়ী ইমা’র গোপন ফাঁদের তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে।

তারা জানান, ইমা ফেসবুকে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আকর্ষণীয় ছবি ও পদবি ব্যবহার করে সিনেমা তৈরির কথা বলে তাদের কয়েকজনের কাছ থেকে অন্তত ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সমপ্রতি একজন উদীয়মান চিত্রাভিনেতার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ছবি না বানিয়ে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। একপর্যায়ে আপত্তিকর ছবি তুলে আরও তিন লাখ টাকা ব্ল্যাকমেইল করেছে। প্রতারিত ওই অভিনেতা টাকা ফেরত চাইতে গেলে তার আপত্তিকর ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিলে সে ভড়কে পিছু হটে যায়। আরেক ভুক্তভোগী দীপঙ্কর সেনগুপ্ত বলেন, ইমা ছদ্মবেশী ক্রিমিনাল। তার পরিবারের বাকি সদস্যরাও প্রতারক। কখনও বাবার অসুস্থতার কথা বলে টাকা নিয়েছে। কখনও মায়ের ক্যান্সারের কথা বলে টাকা নিয়েছে। তবে ওই টাকা আর ফেরত দেয়নি।

গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইমা জানায়, তার ভাই তানভীর খালেদ, পিতা আলমগীর খালেদ, ম্যানেজার কামাল হোসেন এবং কয়েক বন্ধু মিলে প্রতারণা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তাদের এ কর্মকাণ্ডে অনেক ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাও জড়িত। সূত্রমতে, শুধু ইমা নয়, ইমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে তিনটি ওয়ারেন্ট আছে। তার মা প্যারালাইজড। ওই মায়ের কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সে। কিন্তু মায়ের চিকিৎসা না করিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ভাড়া থাকে। চলাচল করে দামি গাড়িতে। তাদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান পরিচালনা করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ইমার ঘনিষ্ঠজনরা জানান, ইমা মাসে এক লাখ টাকার বেশি বাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকে। গাড়ি ভাড়া দেয় ৩-৪ লাখ টাকা করে। দু’দিন পরপরই গাড়ির মডেল বদল করে। তার অসংখ্য বয়ফ্রেন্ড রয়েছে। প্রকাশ্যে বিয়ে করেছে চারজনকে। গোপন সম্পর্কের তালিকা আরও দীর্ঘ। এ ছাড়া বিদেশে লোক পাঠানোর কথা বলে ভুয়া বিয়ের আয়োজন তার আয়ের অন্যতম পেশা। এভাবে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। প্রতারিত আমির হোসেন বলেন, ইমা ও তার পরিবার অভিনব কৌশলে প্রতারণা করেছে। তার কাছ থেকে কয়েক দফায় ৫ লাখ টাকা নিয়েছে। এ ঘটনায় তিনি থানায় অভিযোগ করেছেন।

সূত্র আরও জানায়, রাজধানীর একটি বিউটি পার্লারের আড়ালে র‌্যাম্প মডেলদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আস্তানা গড়ে তুলেছে ইমা। তার সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। ইমা প্রতারণার শুরুতেই সরাসরি হাজির হয় কারও দপ্তরে। অথবা মোবাইল ফোন ও ফেসবুকে যোগাযোগ শুরু করে। পরে বন্ধুত্ব ও প্রেমের অভিনয়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। এরপরই নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতে থাকে। এভাবে গোয়েন্দা পুলিশ গত কয়েক বছরের অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য জানতে পেরেছে তার। তদন্ত সূত্রমতে, তার প্রতারণার জালে আটকে পড়েছেন শতাধিক ভুক্তভোগী। বেশির ভাগ ভুক্তভোগীকে টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টো নারী নির্যাতন মামলার ভয় দেখিয়েছে সে। আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রেম ও বিয়ের অভিনয় করে ইমা অনেক বিত্তশালীর শয্যাসঙ্গী হয়েছে। পরে ব্ল্যাকমেইল করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারিত ওই বিত্তশালীরা মান-ইজ্জত ও সংসার ভাঙার ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে সাহস পাননি। এখন গোপনে তার প্রতারণার বিষয়ে তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক প্রভাবশালী তাকে ছেড়ে দিতেও তদবির করছে।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025