তৌহিদা শিরোপা: আগামীকাল ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক নির্যাতন বাড়ছে। পারিবারিক নির্যাতন এখন আর ব্যক্তিগত সমস্যা নয়…
বদ্ধ ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার কথা কেউ জানবে, এটা কেমন কথা! স্বামী দু-চারটা চড়-থাপ্পড় মারতেই পারেন! দুটো গালমন্দ না হয় করলেনই! চুপচাপ সেসব সহ্য না করলে তো ‘ভালো বউ’ হওয়া যাবে না। সমাজের চোখে ‘ভালো’ হতে গিয়ে, মেয়েটি প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে পারিবারিক নির্যাতনের। যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি গুরুতর না হয়, ততক্ষণ অন্যদের কাছে অজানাই থেকে যায় বিষয়টি।
পারিবারিক সহিংসতার সব খবর গণমাধ্যমে আসে না। তার মানে এই নয় যে নির্যাতন কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্যাতন আগেও হতো, এখনো হয়। আজকাল মেয়েরা প্রতিবাদী হয়েছেন, মুখ বুজে সহ্য করেন না। সে কারণে আমরা জানছি। আবার এ কারণে নির্যাতন, নৃশংসতাও বেড়েছে।
চলতি নভেম্বর মাসেই বেশ কয়েকটি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা আলোচিত হয়েছে। গাজীপুরের টঙ্গীর জামাই বাজার এলাকার ভাড়া বাসায় স্বামী জুয়েল ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চোখ তুলে নেন শিউলির। এরপর তাঁকে তালাবদ্ধ ঘরের ভেতর রেখে চলে যান। চোখ হারিয়ে ফেলেন শিউলি। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আরেক ঘটনায় তপতী দাসের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেন তাঁর স্বামী।
রাজশাহীর নুরেসা বিবির কথাই ধরুন—দুই লাখ টাকা কিস্তি তুলে না দেওয়ায় তাঁর স্বামী চোখ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক জরিপ বলছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৯২ জন নারী। তার মধ্যে ১৬৭ জন নারী স্বামীর হাতে মারা গেছেন। ২৮ জন নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ১১৭।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৮৮ জন নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বামী হত্যা করেছেন ২৬২ জনকে। তবে মামলা হয়েছিল ২৬১টি। স্বামীর হাতে সরাসরি নির্যাতিত হয়েছেন ৩৬ জন।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ নামে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই জরিপে দেখা যায়, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছেন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। (সূত্র: প্রথম আলো ২৩ জানুয়ারি ২০১৪)।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালেও দেখা যাবে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা। সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ান-এর একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজন স্বামীর হাতে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এত সচেতনতা, এত চেষ্টার পরেও কেন পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ হচ্ছে না? এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের জাতীয় সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের সচেতনতা ও প্রতিবাদ মেনে নিতে পারছে না। মেয়েরা মুখ খুলছে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন পুরুষের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। স্ত্রীকে কাজ করতে বলছেন কারণ স্বামীর একার আয়ে পরিবার চলে না। তবে খরচসহ যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে স্বামীর বড় ভূমিকা এখনো দেখা যায়।
আমরা পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট দেশের সব কটি বিভাগে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এই গবেষণায় দেখা যায়, ছয়টি বিভাগে সচেতনতার হার বেড়েছে গড়ে ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় রংপুর ও সিলেটে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির হার কম।
এতে আরও উঠে আসে, ৯৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নারীকে স্বামীরা মারেন, আজেবাজে নামে ডাকেন ও গালাগাল করেন। ৯৫ দশমিক ৬৩ শতাংশের ওপর প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য মানসিক চাপ দেওয়া হয়। ৯২ দশমিক ৯২ শতাংশ নারীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন স্বামীরা। শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীদের ৯৩ দশমিক ১৩ শতাংশকে লাথি ও আঘাত করা হয়। স্বামীর হাতে লাঠির মার খান ৯১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৫৫ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য জোরালোভাবে সক্ষম। ৪৩ শতাংশ মোটামুটিভাবে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারবে।
নারীর এই প্রতিবাদী রূপের সঙ্গে অনেক পুরুষই পরিচিত নন। শুধু স্বামী নন, শ্বশুরবাড়ির পরিবেশের কারণেও মেয়েটি নির্যাতিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব মনে করেন, পারিবারিক পরিবেশ একটা গুরুত্ব বহন করে। নিজের পরিবারে যদি নারী-পুরুষ বৈষম্য থাকে, তাহলে সেই পরিবারের ছেলেটি নারীকে অবহেলার চোখে দেখবে। তিনি বলেন, ‘এটিও একধরনের মানসিক নির্যাতন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অনেকগুলো আমরা পূরণ করেছি। কিন্তু পারিবারিক সহিংসতার হার কমিয়ে আনতে পারিনি বলে এই লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি।’
যেসব ঘটনা প্রকাশ পায়, মামলা হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনি জটিলতা ও আইন রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ সহায়তা না পাওয়ার কারণে মামলা কম হয়। হলেও তা খুব একটা আলোর মুখ দেখে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, নৃশংস ও ভয়াবহ কোনো ঘটনা না ঘটলে নারীরা মামলা করেন না। গ্রামে তো সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে ফেলা হয়। জিডি ও এফআইআর করার সময় মাঝেমধ্যে নারীরা হয়রানির শিকার হন। থানা মামলা নিতে চায় না। থানাগুলোকে নারী ও শিশুবান্ধব হতে হবে। মনিটরিংয়ের অভাবে ও বিশেষ টাস্কফোর্স না থাকায় বেশির ভাগ মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকে। তাই মনিটরিং তো দরকার; পাশাপাশি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার-প্রক্রিয়া হওয়া উচিত।
‘সবার আচরণ একরকম না। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটে। পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রামের মাধ্যমে থানাগুলোকে আরও নারীবান্ধব করার চেষ্টা করছি আমরা। উইমেন হেল্প ডেস্ক চালু করেছে ডিএমপি। ঢাকার তেজগাঁওয়ের উইমেন ইনভেস্টিগেশন সাপোর্ট ডিভিশন ভিকটিমদের সহায়তা ও মামলাগুলোর তদন্ত করে। অনেকে অপব্যবহার করে এই আইনের। এ বিষয়েও সচেতনতা জরুরি।’ বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ—ডিএমপি সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (অর্থ) আবিদা সুলতানা।
শুধু কী বাংলাদেশে? যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও এ বছর জাতিসংঘের কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেনের (সিএসডব্লিউ) ৫৯তম সভায় বলেছিলেন পারিবারিক আইনের প্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে না বলে পারিবারিক নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
এর সঙ্গে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন যতই হোক, পারিবারিক নির্যাতন কমবে না।