শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:০২

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় পাসপোর্ট পেয়েছিলাম আদালতে সাকা‘র দাবী

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় পাসপোর্ট পেয়েছিলাম আদালতে সাকা‘র দাবী

 

 

 

 

 

 

 

 

শীর্ষবিন্দু নিউজ: ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচন করলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া সাক্ষ্যে ব্যক্তি জীবনের বর্ণনার পাশাপাশি বৃটিশ শাসনামল থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় পর্যন্ত নানা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বার বার প্রসিকিউশনের বাধার মুখে পড়েন এই সংসদ সদস্য।

নিজেকে বঙ্গবন্ধুর নিকটজন দাবি করে তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় তখনকার সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুস মাখনের সুপারিশে তিনি বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় কখনও হেসে কখনও উত্তেজিত হয়ে জবাব দেন তিনি। ব্যাখ্যা করেন নিজের অবস্থান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষে তার অবস্থান। কোন বিশেষ ব্যক্তিবর্গ বা দলের বিরুদ্ধে তার অবস্থান নেই। ধারণা এবং বাস্তবতার মধ্যে অনেক সময়ই বড় ফারাক থাকে। এ প্রসঙ্গে তার বন্ধু ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় ঘটে যাওয়া এক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।

এ অঞ্চলের মুসলমানদের বন্ধন মুক্তি এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সাক্ষ্যের এক পর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, মরেই তো যাবো। কিছু রেকর্ড রেখে যাই। গতকাল সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে তৃতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল ১-এ তিনি এ সাক্ষ্য দেন।

দুই দফায় প্রায় চার ঘণ্টায় দেয়া জবানবন্দিতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, পছন্দসূত্রে আমি একজন বাংলাদেশী, জন্মসূত্রে নয়। আমি তখন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম। সে সময় সেখানে একটি সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বিচারপতি স্যার জাফর উল্লাহ খান। তিনি আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক ছিলেন। ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবে জন্ম নেয়ায় তার দেশপ্রেম নিয়ে একজন ছাত্র প্রশ্ন তুলেছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তুমি পাকিস্তানি কারণ তোমার মা পাকিস্তানি। আমি নিজ পছন্দের কারণে পাকিস্তানি। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমি লন্ডনের বাসিন্দা ছিলাম। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে আমি ঢাকায় আসি।

বৃটিশ ভ্রমণ ডকুমেন্ট নিয়ে আমি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন বিভাগে প্রবেশ করেছিলাম। আমি সে বৃটিশ ডকুমেন্ট ইমিগ্রেশন বিভাগে জমা দিয়েছিলাম এবং তখনকার একজন সংসদ সদস্যের সুপারিশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। সে সময় বাংলাদেশী পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের সুপারিশ বাধ্যতামূলক ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় আবদুল কুদ্দুস মাখনের সুপারিশে সে পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। এটা রেকর্ডে থাকা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম নেয়া অনেক মানুষ বাংলাদেশে ফিরেননি। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে লিংকনস্‌ ইন থেকে আমি বার পরীক্ষার প্রথম পর্ব শেষ করি। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় পার্টের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং কাউটস অ্যান্ড কোম্পানিতে কাজ করছিলাম। এরই মধ্যে ১৯৭৩ সালের ১৮ই জুলাই আমার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।

সালাউদ্দিন কাদের বলেন, প্রসিকিউশনের বর্ণনামত চুপিচুপি আমি বাংলাদেশে ফিরিনি। প্রসিকিউশন যেমনটা দাবি করেছে সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৪ অথবা ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় পর্যন্ত আমি কখনওই আত্মগোপনে ছিলাম না। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে কিউসি শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমার কার্যক্রম শুরু করি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত আমি বেশ কয়েক বার ব্যবসায়িক কারণে বিদেশ সফরে গিয়েছি। এটাও সত্য যে, আমাদের রাজনীতির ইতিহাসের কালো দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধে কিছু করতে না পারা আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য খুবই দুঃখের বিষয়। প্রেসিডেন্টের জীবন বাঁচানো যাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল, আজ ৩৮ বছর পর আমরা তাদের মায়াকান্না দেখছি।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমার মরহুম পিতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার সম্পর্ক বঙ্গবন্ধু নিজে তার আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন। সে জাতীয় ঐতিহ্য (‘বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী’) বঙ্গবন্ধুর এক নিকটজনের এ নিপীড়নমূলক বিচারে প্রদর্শনী হিসেবে গ্রহণ করতে প্রসিকিউশন অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আমি আমার জীবনে প্রথম বার গ্রেপ্তার হয়েছিলাম ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর- খোন্দকার মোশ্‌তাক আহমাদের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে। তিনি আমার পিতার ধানমন্ডির বাড়ি দখল করেছিলেন।

সালাউদ্দিন কাদের তার আগের দিনের দেয়া জবানবন্দির একটি অংশের সংশোধনী দিয়ে বলেন, বঙ্গভঙ্গের সময় ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন। মুসলমানদের বন্ধন মুক্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা উল্লেখ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমিও সেই মুসলিম উম্মাহর সদস্য। তিনি বলেন, ২০০ বছর ধরে ভারতে মুসলমানরা বৃটিশ রাজের ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। বৃটিশরা ভাগ ও শাসনের (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি অনুসরণ করেছিল। তারা হিন্দুদের সুবিধা দিয়েছিল আর মুসলিমদের করেছিল বঞ্চিত। বাংলা ভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোধিতা মুসলিমদের আহত করেছিল। বৃটিশরাজও এতে বিরক্ত হয়েছিল। এর ফলস্বরূপ ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাজধানী। ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্যার সৈয়দ আহমদের আমন্ত্রণে একটি সম্মেলন হয়েছিল। আলাদা রাষ্ট্রের জন্য মুসলমানরা আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলন মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এরপর ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ছুটে যান লাহোরে। যেখানে তিনি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রসমূহ (ংঃধঃবং) প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন।

তিনি আরো বলেন, কাজী নজরুল ইসলামকে এ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া বঙ্গবন্ধুর কোন সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং এর মাধ্যমে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারই প্রকাশ পেয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যার বিরুদ্ধে আমার প্রকাশ্য অবস্থান রয়েছে। প্রসিকিউশন এ বক্তব্যে তীব্র আপত্তি জানায়। পরে তা বাদ দেয়া হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বার বার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সময় বেঁধে দেয়ার কথা বললে তিনি বলেন, ফাঁসি তো দেবেনই। তাড়াহুড়ার কি আছে? সাক্ষ্য কালে ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, এডভোকেট রেজাউল করিম প্রমুখ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

সালাউদ্দিন কাদের বলেন, এটা আমার বিশ্বাস যে ধারণার সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবতার ফারাক থাকে। এ প্রসঙ্গে রেকর্ডেড জবানবন্দির বাইরে তিনি বলেন, আমার সম্পর্কে ধারণা থেকে অনেক কথা বলা হয়। অনেকে হয়তো আমার নাম শুনলেই ভেবে বসেন পাকিস্তানের কথা, ভাবেন আমি অ্যান্টি ইন্ডিয়ান। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, জর্জটাউন স্কুল অব ফরেন সার্ভিসে পড়ার সময় যশবন্ত সিংহ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমি এবং আমার স্ত্রী তার পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। একসময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ৯০-এর দশকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে যশবন্ত সিং-ও বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে সময় আমার অফিসের স্টাফরা আমাকে না জানিয়ে এক ঝুড়ি আম যশবন্ত সিং-এর কাছে পাঠানোর জন্য রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে জমা দিয়েছিলেন। সেখানে আমার একটি ভিজিটিং কার্ডও দেয়া হয়। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে রেড এলার্ট জারি করে। আমাকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, ঝুড়িতে কোন বিস্ফোরক দ্রব্য আছে কিনা? প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন আপত্তি জানিয়ে বলেন, উনি অনেক ভাল ইংরেজি বলছেন। বহুদিন এত ভাল ইংরেজি শুনি না। শুনতে ভাল লাগছে। কিন্তু এ মামলার সঙ্গে এসব বক্তব্যের কোন সম্পৃক্ততা নেই। এসব বক্তব্য বাদ দিতে হবে। এসময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আপনারা আড়াই বছর বলেছেন। অথচ আমাকে বলতে দিচ্ছেন না। আমার সম্পর্কে তো আমাকে বলতে দিতে হবে। এটা তো ম্যাকবেথের ভূত নয়। আমাকে তো আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে। রাজনীতি মুষ্টিযুদ্ধ নয়।

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024