শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফিলিপিন্সে সরানো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮১ মিলিয়ন ডলার স্থানীয় মুদ্রা পেসোতে রূপান্তরকারী মুদ্রা বিনিময় কোম্পানি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিনিময় বাবদ তাদের আয় ফেরত দেবে বলে জানিয়েছে। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সরানো বাংলাদেশের অর্থ থেকে ফিলিপিনো মুদ্রায় ২০ মিলিয়ন পেসো দেশটির রিজল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপকের গাড়িতে করে নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যাংক কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবার ফিলিপিন্সের প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও অনুসন্ধান সংক্রান্ত সিনেট কমিটির (ব্লু রিবন কমিটি) শুনানিতে উপস্থিত হয়ে এ কথা বলেন ফিলরেম সার্ভিস ইনকরপোরেশন নামে ওই মুদ্রা বিনিময় কোম্পানির প্রেসিডেন্ট সালুদ বাউতিস্তা।
বিনিময় করা মুদ্রা বাংলাদেশের চুরি করা অর্থ থেকে এটি তার কোম্পানি জানত না দাবি করে তিনি বলেন, আমরা দুঃখিত। এই মুদ্রা বিনিময় থেকে তাদের পাওয়া স্থানীয় মুদ্রায় এক কোটি চার লাখ ৭৪ হাজার ৬৫৪ পেসো বা প্রায় দুই লাখ ২৬ হাজার ডলার দ্রুতই বাংলাদেশ সরকারের নামে একটি চেক লিখে ফেরত দেওয়া হবে বলে শুনানিতে বলেন তিনি।
গত মাসে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) মেসেজিং সিস্টেমে জালিয়াতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে ভুয়া নির্দেশনা পাঠিয়ে বাংলাদেশের প্রায় এক বিলিয়ন টাকা সরানোর চেষ্টা হয়। এর মধ্যে ৮১ মিলিয়ন ডলার যায় ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) চারটি অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে স্থানীয় মুদ্রা পেসোতে রূপান্তরের পর ওই টাকার একটি অংশ চলে যায় দুটি ক্যাসিনোতে।
জুয়ার টেবিলে আয় বৈধ করার সুযোগ নিয়ে হাতবদলের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায় ওই টাকা। ফিলিপিন্সের ইনকোয়ারার পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন হলে মার্সের শুরুতে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। অর্থ পাচারের এ ঘটনায় ফিলিপিন্সের প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও অনুসন্ধান সংক্রান্ত সিনেট কমিটির (ব্লু রিবন কমিটি) শুনানিতে বৃহস্পতিবার এই কথা বলেন ব্যাংকের মাকাতি সিটির ওই শাখায় ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাস্টমার সার্ভিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রোমুয়াল্দো এগাররাদো।
ফিলিপিন্সের সংবাদপত্র ইনকোয়ারার এই খবর দিয়েছে, যারা বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের এই খবরটি প্রথম প্রকাশ করেছিল এবং যাতে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লোপাটের তথ্য। ৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো’র নামে করা অ্যাকাউন্ট থেকে স্থানীয় মুদ্রায় ২০ মিলিয়ন পেসো তোলার পর তা কাগজের ব্যাগে করে শাখা ব্যবস্থাপক মাইয়া সানতোস দেগিতোর গাড়িতে তোলা হয় বলে শুনানিতে দাবি করেন এগাররাদো।
তিনি বলেন, ৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক অ্যাঙ্গেলা তোরেস ক্যাশ সেন্টার থেকে ওই ২০ মিলিয়ন পেসো দেওয়ার কথা বলেন। এরপর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে টাকা পরিবহনের জন্য একটি গাড়ি ক্যাশ সেন্টার থেকে আসে। আমাদের ২০ মিলিয়ন পেসো গুনতে হচ্ছিল, ক্যাশ কাউন্টার থেকে এই পরিমাণ অর্থই চাওয়া হয়।
তিনি ও সহকারী ব্যবস্থাপক তোরেস সেই অর্থ ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের কাছে দেন বলে দাবি এগাররাদোর। সাড়ে ৬টা থেকে পৌনে ৭টার দিকে টেলার (ক্যাশিয়ার) ওই পেসো একটি বাক্সে নিয়ে গুনে ব্যবস্থাপক দেগিতোর কক্ষে নিয়ে যান। ওই মুহূর্তে ব্যবস্থাপক কক্ষের বাইরে ছিলেন, আমার মনে হয় তিনি বাইরে মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। ব্যাংকের পিয়ন জোভি মোরালেস বাক্স থেকে ওইসব পেসো পেপার ব্যাগে ভরে তোরেসের সাহায্যে বাইরে রাখা ব্যবস্থাপক দেগিতোর গাড়িতে তুলে দেন বলে দাবি করেন তিনি।
ব্যাংকের মূল দরজার সামনেই তার বসার টেবিল হওয়ায় কাচের স্বচ্ছ দরজা দিয়ে ওই অর্থ গাড়িতে তুলতে দেখেছেন বলেও দাবি এগাররাদোর। উইলিয়াম গো নামে যে ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্ট থেকে এসব অর্থ তোলা হয় সেই অ্যাকাউন্টটি তার নয় বলে ইতোমধ্যে দাবি করেছেন তিনি। ব্যাংকে এই অ্যাকাউন্ট খোলা এবং অর্থ উত্তোলনের স্লিপে যে স্বাক্ষর রয়েছে সেটি ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো’র কি না সেটি নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি।
ফিলিপিন্সের ফিলস্টার পত্রিকা জানায়, রিজল ব্যাংকের আইন ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভাগের প্রধান মারিয়া সিসিলিয়া ফার্নান্দেস-এস্তাভিলো শুনানিতে জানিয়েছেন, ব্যাংকের এক অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে ব্যাপকভাবে নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে যে ওই অ্যাকাউন্ট খোলা এবং অর্থ উত্তোলনের স্লিপের স্বাক্ষরটি ব্যবসায়ী গোর নয়। তবে জুপিটার স্ট্রিট শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক অ্যাঙ্গোলা তোরেস ব্যাংক অডিটরদের কাছে ভিন্ন কথা বলেছেন। উইলিয়াম গো নিজেই অর্থ তুলতে এসেছিলেন এবং উত্তোলনে স্লিপে তাকে স্বাক্ষর করতে দেখেছেন বলেও দাবি তোরেস।
ওই সাক্ষ্য দেওয়ার পর ব্যাংক অডিটরস, কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের জেরার কারণে তিনি চাকরি ছেড়েছেন বলে স্থানীয় একটি রেডিওতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তোরেস। ওই রেডিওতে দেওয়া সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে ফিলস্টার জানায়, ব্যবসায়ী উইলিয়াম গো লেক্সাস এসইউভি মডেলের একটি গাড়িতে এসেছিলেন এবং আগেও বিভিন্ন সময়ে ওই শাখা থেকে অর্থ উত্তোলনের কারণে তোরেস তাকে ভালো করেই চিনতেন।
এদিকে এসব অর্থ ছাড় না করালে ব্যবস্থাপক দেগিতো নিজের বা তার পরিবারের সদস্যদের কারও প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা তাকে বলেছিলেন বলেও শুনানিতে দাবি করেন জুপিটার স্ট্রিট শাখার ওই সময়ের কাস্টমার সার্ভিসের প্রধান রোমুয়াল্দো এগাররাদো। ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে সহকারী ব্যবস্থাপক অ্যাঙ্গোলা তোরেসের সামনেই দেগিতো প্রাণনাশের ওই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন তার তার দাবি।
মাইয়া সানতোস দেগিতোর উদ্বৃতি দিয়ে এগাররাদো শুনানিতে বলেন, আমার (দেগিতো) হয় এটা (অর্থ ছাড়) করতে হবে, না হয় আমাকে বা আমার পরিবারকে হত্যা করা হবে। তবে এ বিষয়ে সিনেটরদের নিশ্চিত হলে চাইলে এ ধরনের কোনো কথা তিনি বলেননি বলে দাবি করেন দেগিতো।
সব কথা বিস্তারিতভাবে বলার জন্য সিনেটরদের কাছে আগেরদিনের মতো বৃহস্পতিবারের শুনানিতেও একটি রুদ্ধদ্বার বিশেষ সেশন চান তিনি। আগের দিন দেগিতোর এই আবেদন নাকচ হলেও এদিন তা মেনে নেনে সিনেটররা। এই ঘটনার পুরো দায় শাখা ব্যবস্থাপক দেগিতোর উপরই দিচ্ছেন রিজল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জো তান। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ তদন্তেও বলা হয়েছে, দেগিতোই ব্যবসায়ী গো’র নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন।
তবে দেগিতোর ঊধ্বর্তন কোনো কর্মকর্তা এতে জড়িত কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে রিজল ব্যাংকের আইনজীবী মাসেল এস্তাভিল্লো জানিয়েছেন। দেগিতো শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, তিনি যা করেছেন, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই করেছেন। তাকে বলির পাঠা বানানো হবে বলে শঙ্কাও প্রকাশ করে আসছেন তিনি।