রোকনুজ্জামান পিয়াস: অতি প্রচারণাই মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সরকার এত বেশি প্রচার চালিয়েছে যে সেখানকার বিভিন্ন সংগঠন এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তাছাড়া ১৫ লাখের যে সংখ্যাটা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে তা সহজেই সে দেশের বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
তারা যুক্তি দিয়েছে, এমনিতেই দেশটির নাগরিকরা সেখানে কাজ পাচ্ছে না, দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এরপর বিদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক এ কর্মী নেয়া হলে তারা আরও বেশি সমস্যায় পড়বে। অন্যদিকে এই কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় সানারফ্লাক্স নামে প্রতিষ্ঠানের মনোপলি ব্যবসার নানা ত্রুটি তুলে ধরে গোষ্ঠীগুলো সরকারের কাছে কর্মী নেয়া বন্ধের দাবি জানায়। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক এ কর্মী নেয়ার পদক্ষেপ থেকে সরে এসেছে। যদিও এই ঘোষণার একদিন আগে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে দেশটি।
সূত্র জানিয়েছে, দেশটিতে এমনিতেই প্রচুর পরিমাণ বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বসবাস করছে। তার ওপর নতুন করে এই ১৫ লাখ কর্মী নেয়ার ঘোষণায় স্থানীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেশটিতে মূলত চারটি গোষ্ঠী বা সংগঠন সরকারের এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসছিল। এই সংগঠনগুলোর মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন, বার কাউন্সিলর, স্থানীয় সিভিল সোসাইটি এবং এমপ্লয়মেন্ট ফেডারেশন উল্লেখযোগ্য।
এই সংগঠনগুলো সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিপুল পরিমাণ বিদেশি শ্রমিকের ব্যাপারে বরাবরই আপত্তি জানিয়ে আসছিল। বিশেষ করে ২০০৮-০৯ সালে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি দেশটিতে গমন করে। ফ্রি-ভিসার মাধ্যমে এসব কর্মী যাওয়ায় দিনের পর দিন অনেকেই বেকার জীবনযাপন করেন। ওই সময় বাংলাদেশিদের অনেকেই মালয়েশিয়ায় কাজ না পাওয়ায় নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। তাদের এ অপকর্মের সঙ্গে অনেক সময় স্থানীয় সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জড়িয়ে পড়েন।
তাদের প্রতিক্রিয়া এবং দাবির কারণেই মূলত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয় দেশের অন্যতম এ শ্রমবাজার। তারপর নানা কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১২ সালে জি টু জি পদ্ধতিতে চালু হয় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া। এ জন্য সেসময় ঢাকঢোল পিটিয়ে ১৪ লাখ মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুকে রেজিস্ট্রেশন করানো হয়।
পর্যায়ক্রমে এই ১৪ লাখের ভেতর থেকে লটারির মাধ্যমে দেশটিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই হেঁাঁচট খায় এই পদ্ধতি। এছাড়া বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই পদ্ধতির বিরোধিতাও শুরু করে। এমনকি এই পদ্ধতি ব্যর্থ করার জন্য সেদেশে লবিস্টও নিয়োগ করে বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা। ২০১২ সালে জি টু জি পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত কর্মী গেছে মাত্র ৯ হাজারের মতো। দেশটিতে কর্মী নিয়োগে জি টু জি পদ্ধতির ব্যর্থতার ফলে বিকল্প খুঁজতে থাকে উভয় দেশের সরকার।
গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে পাঁচটি খাতে বাংলাদেশ থেকে তিন বছরে ১৫ লাখ কর্মী নিতে সমঝোতা স্মারকে সই করে মালয়েশিয়া। প্রবাসী কল্যাণ ভবনে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জায়েম এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি এই সমঝোতা স্মারকে সই করেন। অবশ্য সমঝোতা স্বাক্ষরের বেশ আগে থেকেই এই বিষয়ে চলছে অতি প্রচারণা। উভয় দেশের সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে ফলাও করে সংবাদ প্রচার করে।
সর্বশেষ সমঝোতা স্বাক্ষর হওয়ায় সোচ্চার হয় মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সংগঠন। তারা বিদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এ ব্যাপারে তারা দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকটি পর্যালোচনা তুলে ধরে চিঠি দেয়। তাতে তারা উল্লেখ করে, এখনও দেশটিতে বিপুলসংখ্যক কর্মী অবৈধভাবে অবস্থান করছে। সেগুলো নিয়মিত না করে নতুন করে কর্মী নিলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। দেশটিতে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা চলছে এই অবস্থায় বাইরে থেকে নতুন কর্মী নিয়োগ বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিদেশি শ্রমিকদের কারণে স্থানীয় শ্রমিকরা চাকরিচ্যুত হচ্ছে। কারণ কোম্পানিগুলো বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করতে পারে তা স্থানীয়দের সঙ্গে করতে পারে না।
তাছাড়া স্থানীয় ও বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে বেতনেরও তারতম্য রয়েছে। ফলে নিয়োগকর্তা সহজেই বিদেশি শ্রমিকদের পছন্দ করে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে। এ বিষয়গুলো তুলে ধরে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের দাবি জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এসব ঘটনার পাশাপাশি সানারফ্লাক্স নামে একটি কোম্পানির যে মনোপলি ব্যবসা করার মনোভাব তাও এ ব্যাপারে প্রভাব ফেলেছে। এ প্রক্রিয়া চালু হলে মানুষ কেনাবেচায় হতো বলে তারা মনে করেন।
ইতিপূর্বে এ বিষয় নিয়েও একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফলে সমঝোতা স্বাক্ষরের একদিন পরই সাতটি দেশ থেকে শ্রমিক নেয়া স্থগিত করে দেশটি। অভিবাসী কর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ওয়ারবী ফাইন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক উল্লিখিত বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করে বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে দেশটি বাংলাদেশ থেকে যে কর্মী নিতে চেয়েছিলে তা ইতিবাচক।
তবে এটা নিয়ে এক ধরনের রাজনীতির চেষ্টাও করা হয়েছে। সরকার বড় সাফল্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। ফলে ১৫ লাখ সংখ্যাটিকেই তারা ফলাও করে প্রচার করেছে। এ বিষয়টিই দেশটির স্থানীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
তিনি বলেন, কর্মী যাবে এটাই বড় কথা। সংখ্যাটাকে এত বড় করে দেখানোর দরকার ছিল না। সাইফুল হক বলেন, যেকোনো চুক্তি করার আগেই বাস্তবতা চিন্তা করতে হবে। চুক্তিগুলো উন্মুক্ত না করা হলে আমরা আদৌ বুঝতে পারবো না তাতে কী আছে। এজন্য চুক্তিগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন।
তবে বায়রার সিনিয়র সহসভাপতি আলী হায়দার চৌধুরী ঘোষণা চুক্তি এবং সমঝোতা স্বাক্ষরের একদিন পরই বন্ধের ঘোষণাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি দেখছেন না। তিনি বলেন, প্রচারণাটা তারাই প্রথমে করেছিল এবং ১৫ লাখ লোক নেয়ার সিদ্ধান্তটাও তাদেরই ছিল। পরে তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপের কারণে পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। তারা যাচাই করছে প্রকৃতপক্ষে তাদের কত লোক দরকার। সেদেশে মিডিয়ায় প্রচারণার কারণেই কী অভ্যন্তরী গোষ্ঠীগুলো
এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে তা না। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তারা এই কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।