নিউজ ডেস্ক: কুখ্যাত ফারাও সাম্রাজ্যের দেশ মিশর, রাজতন্ত্রের নামে ‘স্বৈরতন্ত্র’র প্রতিষ্ঠাতা গামাল আবদুল নাসেরের দেশ মিশর, স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের দেশ মিশর। শতো বছর ধরে নিপীড়িত এ দেশটির জনগণও ২০১১ সালের আগে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ পায়নি, পায়নি নিজেদের ন্যূনতম অধিকার প্রাপ্তির কথা বলতে অর্থাৎ পায়নি সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বাদ।
তাহলে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টকে বা তার গণতান্ত্রিক শাসনামলকে কেন সহ্য করতে পারলো না মিশরের জনগণ? কেনইবা এক বছর আগে সর্বাধিক ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছিল মিশরীয়রা? কেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধরে রাখতে পারেননি মুরসি- কী চায় মিশরীয়রা? এ ধরনের প্রশ্ন সারা মিশর ছাড়িয়ে আজ বিশ্বের সর্বত্র? কেউ কেউ ‘ধর্মনিরপেক্ষ, বামপন্থি ও মোবারকপন্থিরা কট্টর ইসলামপন্থি ব্রাদারহুডের সরকার পরিচালনাকে সহ্য করতে পারছে না বলেই এই ইউটার্ন’ বলতে চাইলেও রাজনৈতিক ও সমাজ বিশ্লেষকরা কিন্তু এ ব্যাপারে পুরোপুরি একমত নন। মুরসিবিরোধী আন্দোলনে আদর্শিক বিরোধিতা খানিকটা গতি দিয়েছিল ঠিক, তবে তার চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল মিশরের সাধারণ জনগণ কিন্তু মুরসিকে ভোট দিয়েছিল স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের চেয়ে একজন ভাল শাসক পাওয়ার আশায়।
কথায় আছে ‘প্লাবন নামলে ঈদুর-বিড়ালের মতো প্রাণীও একখণ্ড কাঠে আশ্রয় নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারে’। হোসনি মোবারকের পতনের পর এই রকম রাজনৈতিক প্লাবন থেকে বাঁচতেই আদর্শিক বিরোধীরা একখণ্ড কাঠে অর্থাৎ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল, বেঁচেছিল অন্য কোনো সেনাশাসকের হাত থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় দফার ভ্যুত্থানের কারিগর মুরসিবিরোধীদের অভিযোগ, “হোসনি মোবারকের দুঃশাসন থেকে বাঁচতে মুরসিকে নির্বাচিত করা হলেও তিনি যেন সেই জ্বালাটিই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শত বছর ধরে মুসলিম-খ্রিস্টান এক ছাদের নিচে বসবাস করে আসলেও গত একবছরে মিশরকে কট্টর-গোঁড়া রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি তিনি। মুরসি মিশরের জনগণের ওপর নিজের ইচ্ছানুযায়ী প্রণীত সংবিধান চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন।
মুরসিবিরোধীদের অভিযোগ, গায়ের জোরে সংবিধান চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছেন যেমন- তেমনি যদি আরও ক’বছর ক্ষমতায় থাকতেন তাহলে মিশরকে ‘দ্বিতীয় তালেবান রাষ্ট্র’ বানিয়ে ফেলতেন মুরসি। তাছাড়া, হোসনি মোবারকের শাসনকালে সুবিধাভোগী অনেক আমলাকেও স্বপদে বহাল রেখেছেন কেবল নিজের দল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি দুর্বলতার কারণেই। মুরসি মিশরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করার আশ্বাস দিয়ে আসলেও তিনি ব্যস্ত ছিলেন একটি গোঁড়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। সরকারবিরোধীরা আরও অভিযোগ করেন, “আমরা মোবারকের স্বৈরশাসন থেকে যেমন বাঁচতে চেয়েছিলাম, তেমনি চেয়েছিলাম স্বাধীনভাবে চলতে, ফিরতে, কথা বলতে, উঠতে-বসতে। কিন্তু মুরসি আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ দেননি। বরং তিনি ‘নতুন ফারাও’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছিলেন।” ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী দেশটির সেনাবাহিনীও কট্টরপন্থি প্রেসিডেন্টকে হটাতে জনতার সমর্থন খুঁজছিল।
ফলাফল, অল্প ক’দিনের তাহরির স্কয়ার দখলের পর সেই অজুহাতে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করলো সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর এ ধরনের হস্তক্ষেপ স্বাগতও জানালো সারাজীবন সেনাবাহিনীর রোষানলে থাকা অর্থাৎ সামরিক শাসনে পিষ্ট মিশরীয় জনগণ!
তবে বেসামরিক বৈষম্য থেকে নিশ্চয় সামরিক শোষণ সুখকর হবে না। মিশরের দ্বিতীয় বারের অভ্যুত্থানকারীরা এখন সামরিক শোষণের শিকার না হলেই হয়। এখন সারাবিশ্বই মিশরীয় জনগণের ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। চতুর সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ সিসি সাংবিধানিক আদালতের প্রধানকে সাময়িকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে রাখলেও শেষ পর্যন্ত তিনি হোসনি মোবারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ কিনা এ সংশয়ও দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি আস্তে আস্তে সামাল দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের পদটিও দখল করতে পারেন সেনাপ্রধান সিসি এ আশঙ্কাও কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে শ্রেণী সংগ্রামের দ্বন্দ্ব হোক আর আদর্শিক দ্বন্দ্ব হোক যে কারণেই হোক মুরসির পতন হয়েছে। সবার এখন কামনা সত্যিকারের একজন গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মিশরের গণতন্ত্র বঞ্চিত মানুষকে গণতন্ত্রের স্বাদ দেবেন।
Leave a Reply