শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৩:১৫

ওয়ান ইলেভেন নিয়ে অজানা কথা বললেন মোখলেস চৌধুরী

ওয়ান ইলেভেন নিয়ে অজানা কথা বললেন মোখলেস চৌধুরী

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সাবেক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট সাংবাদিক, বাংলাদেশের বৈদেশিক সাংবাদিক সংস্থা ওকাব-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট মোখলেস চৌধুরী ১/১১-এর অন্যতম সাক্ষী। যে কজন মানুষ ১/১১-এর ঘটনা ঘটার সময় উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে মোখলেস চৌধুরী অন্যতম। তিনি সব কিছু খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এক-এগারো কার ইঙ্গিতে হয়েছে, কীভাবে হয়েছে সব কিছুই নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি নিশ্চিতভাবে এই ইতিহাসের একটি অংশ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে অবস্থানকালে ঠিকানাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অনেক চাঞ্চল্যকর, শিহরণ জাগানো কথা বলেছেন।

এখানে শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-

আপনি কবে এবং কী কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন?   যুক্তরাজ্য সফর শেষে এখন যুক্তরাষ্ট্র সফর করছি। আত্মীয়- স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে।   ব্যক্তিগত সফরে এলেও দেখা গেছে আপনি কংগ্রেসম্যানসহ অন্য কর্মকতাদের সাথে বৈঠক করেছেন, দেখা করেছেন, বিষয়টি কি বলবেন?   কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলিসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, হোয়াইট হাউজ এবং জাতিসংঘের অনেক কর্মকর্তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। কাজের কারণে অনেকের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং সেই সুবাদে তাদের সাথে আমার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। তারা যখন ঢাকায় গিয়েছিলেন তখন বঙ্গভবনেও তাদের সাথে আমার সাক্ষা‍ৎ হয়েছিল।

ক্রাউলি ছাড়া আর কার কার সাথে বৈঠক হয়েছে?
ক্রাউলি ছাড়া আর যাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তারা অফিসিয়াল। তারা জনপ্রতিনিধি নন। বাংলাদেশ আমাদের দেশ। বাংলাদেশের উন্নয়নে আমাদেরকেই ভূমিকা রাখতে হবে সম্মিলিতভাবে, জাতিকে বিভক্ত করে নয়। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা আমাদেরকে দেশে- বিদেশে তুলে ধরতে হবে। যে জাতি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছে, সে জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ভাল দিক আছে, যেগুলো প্রবাসী বাংলাদেশীরা গ্রহণ করবেন। আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে হিংসা- বিদ্বেষ, ঘৃণা, তুলনা, হায়- আপসোস ইত্যাদি বিরাট সমস্যা। অনেক মানুষ অলস জীবন যাপন করে। আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের উন্নত জীবনের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশীরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেইভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানব সম্পদ। এই মানব সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। জাতির সামনে এবং নেতৃত্বের সামনে ভিশন এবং মিশন দুটোই থাকতে হবে। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও তারা পরস্পর পরস্পরের শক্র নয়- এই মানসিকতা যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জাতিকে অনেক খেসারত দিতে হবে। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ দুই ভাগে বিভক্ত। কিন্তু জাতি হিসাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ। রাজনীতি আমাদের করতে হবে। নির্বাচনের মধ্যদিয়ে একটি দল ক্ষমতায় যাবে, আরেকটি দল অবস্থান নিবে বিরোধী দলে। যখন যারা ক্ষমতায় যাবেন তাদের মনে রাখতে হবে- সারা দেশের মানুষের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত- এই মানসিকতা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সংকীর্ণতা পরিহার করতে পারবো না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে তাদের আপন আপন অবস্থানে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। জাতীয় নেতাদের নিয়ে আমাদের বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে। রাজনীতিই আমাদের বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে, এই রাজনীতিকে ধ্বংস করা যাবে না।

অনেকেই বলেন ১/১১ পূর্ব পরিকল্পিত। আপনিতো এই ঘটনার ঐতিহাসিক সাক্ষী। কিছু বলবেন কি?   এই ঘটনা যেদিন ঘটেছে সে দিন এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। অনেক আগে থেকেই এ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিলো। দুই নেত্রীকে আমি একাধিকবার আমার আশংকার কথা ব্যক্তও করেছিলাম। তাদের দুই জনকে এক সাথে বসাতে চেয়েছিলাম। খালেদা জিয়া বসতে রাজি হয়েছিলেন কিন্তু শেখ হাসিনা বসতে চাননি। কারণ বিএনপির ওপর শেখ হাসিনার ক্ষোভ ছিল।

ড. কামাল হোসেনের কোনো ভূমিকা ছিল?   ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরী এবং কর্নেল অলি দীর্ঘদিন থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর জন্য ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ বিশেষও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলো। পাঁচ বছরে বিএনপি সরকারের পুরোটা ভোগ করে সেই সরকারের বিদায়ের আগে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী বি. চৌধুরী ও কর্নেল অলির দলে ঘটা করে যোগদানের ঘটনাতো সবাই দেখেছেন। ড. কামালতো ২০০৫ থেকে এ প্রক্রিয়ায় জড়িত উল্লেখ করে হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। ড. কামাল সম্পর্কে আব্দুল গাফফার চৌধুরী ও শেখ হাসিনা যা বলেছেন তাতে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার কালো টাকা সাদা করা, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে থাকা, নির্বাচনে জয়লাভ না করতে পারা ও অগণতান্ত্রিক শক্তির দালালি করার ঘটনার সাক্ষীতো সবাই।

আপনি কি মনে করেন ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে এবং যে নির্বাচন হবে তার মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে?

এখন সরকারের যে প্ন্যান রয়েছে বা তারা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে করে মূল সাঁতারুদের হাত পা বেঁধে তাদের পানিতে ফেলে সাঁতার দেয়ার মতো ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কৃত্রিমভাবে সীমিত সংখ্যক জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তাতে প্রকৃত জন রায় ফুটে উঠবে না।  

 

নির্বাচন হবে বলে কি আপনি মনে করেন?

নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন কীভাবে করা হবে সেটাই প্রশ্ন।

 

১/১১-এর পর শেখ হাসিনার সাথে আপনার কি যোগাযোগ হয়েছে বা কথা হয়েছে?

শেখ হাসিনা একজন নেত্রী। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতেই পারে।

 

দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

দুর্নীতি দমন অভিযান প্রথমে যেভাবে শুরু করা হয়েছিল দুই নেত্রী তাতে কোনো আপত্তি করেননি। দুই নেত্রীকে আনটাচড রেখে সত্যিকার অর্থে যারা বাংলাদেশে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের যদি সুষ্ঠু বিচার করা হতো তাহলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস দুই নেত্রীর সমর্থন সরকার পেত এবং এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসতো তাদের পক্ষে দুর্নীতি করা কঠিন হয়ে পড়তো। দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলাগুলো যদি সৎ উদ্দেশ্যে দেয়া হতো তাহলে তাদের বিদেশে চিকিৎসায় পাঠালে পরে দেশে ফেরা যাবে না, রাজনীতি ছাড়তে হবে, রাজনীতি ছাড়লে দুর্নীতির মামলা তুলে আজীবন সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হবে ইত্যাদি উদ্যোগ নেয়া হয় কেন? এর ফলে সবাই আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছেন বলে আমি মনে করি। দুই নেত্রীকে মাইনাস করার উদ্দেশ্য থেকে প্রমাণিত হয় তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে নেতৃত্ব থেকে বের করে দেয়া। বাংলাদেশের জনগণ যদি তাদেরকে চায়, তাহলে পৃথিবীর এমন কোন গণতন্ত্র আছে, যে গণতন্ত্রে তাদের বের করে দেয়ার কথা বলা হবে! আমি এক দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা করবো আরেক দিকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে শ্রদ্ধা করবো অথচ তাদের উত্তরাধিকার হিসাবে যারা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন সেই দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে চাইবো, এটা কি গণতন্ত্রের পক্ষে? আমরা একটি নির্বাচন করতে চেয়েছিলাম যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ মহা জোট অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতো। এই দুটি দলের একটি দলকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে তা ছিল আমাদের কল্পনারও অতীত। কিন্তু আজ দেখছি একটি প্রধান দল নয়, দুটি প্রধান দলকে বাইরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটাই কি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ বাস্তবায়নের নমুনা?

বাংলাদেশে এখন সর্বক্ষেত্রেই অস্থিরতা- এর কারণ কী?

আমি মনে করি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না থাকাই এর মূল কারণ। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলা হয় ডেমক্রেসি ইজ দা বেস্ট ফর্ম অব রুল ইভেন ইফ ইট ইজ দ্য ওয়ার্স্ট।

 

আপনি বঙ্গভবনের দিনগুলো নিয়ে একটি লেখা শুরু করেছিলেন। কয়েকটি পর্ব দেখেছিলাম এখন দেখছি না, কারণ কী?

বঙ্গভবনের দিনগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে লিখছিলাম। আমি বাইরে চলে আসলে ওই লেখাগুলোর স্টক প্রায় শেষ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে বাকি লেখাগুলো আমার এখনো গুছিয়ে আনতে সময় লাগছে। আমি মনে করি বাংলাদেশ আমাদের সবার। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষেরই বাংলাদেশকে নিয়ে ভাববার বা উন্নয়নে যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। ভারতের মতো দেশে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অন্য কেউ রাখবেন এটা চিন্তাই করা হয় না। আমি যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে ছিলাম তখন এক শ্রেণীর সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিক, আমলাসহ যে সমস্ত লোক আমার সম্পর্কে অপপ্রচার করেছিলেন তারা কেবলই হিংসার বশবর্তী হয়ে সেই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছিলেন। অথচ ওই উল্লিখিত শ্রেণী পেশার মেজরিটি আমার পক্ষে ছিলেন। আমি বঙ্গভবন থেকে চলে আসার পর সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বিভিন্ন এজেন্সি আমার বিরুদ্ধে সকল স্থানে অনেকগুলো তদন্ত চালিয়েছেন এবং আমার সততার রিপোর্ট তারা পেশ করতে পেরেছেন। বর্তমান জামানায় এমন সৎ মানুষ থাকতে পারে দেখে তারা কেবলই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে যাবার আগে সকলকে সকল ধরনের ‘ডব্নিউ’ থেকে মুক্ত হতে হবে। টাকা পয়সার প্রতি লোভ রাখা যাবে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তার কাছে সমান হতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতি নেয়া শপথ অক্ষুন্ন রাখতে হবে। যেমনটি আমি করেছিলাম।

 

বঙ্গভবনের শেষ দিনের কথা একটু বলবেন কী বা আপনি কীভাবে গেলেন এবং অন্যরা কীভাবে এলেন?

বঙ্গভনের শেষ দিন বলতে অর্থাৎ ১/১১ নিয়ে আমি এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করবো না। কারণ এটি ইতিহাসের বিষয়বস্তু। ইতিহাসের প্রয়োজনেই আলোকপাত করতে চাই না। তবে এদিন কি ঘটেছিল যারা ঘটিয়েছেন তাদের মুখ থেকেই জাতি ইতিমধ্যে অনেক খণ্ড চিত্র জানতে পেরেছেন। কিছু মিডিয়া সেই দিনের ঘটনা সম্পর্কে নিজ নিজ ধারণা আনুযায়ী আলোকপাত করেছে যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। ৯০ দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার ভূমিকা রাখতে গিয়ে কমনওয়েথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়ান বাংলাদেশি সাংবাদিকতার সেই ইমাজিনারি ভূমিকা নিয়ে কেবলই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ১/১১ এর পর বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে সেই সম্পর্কে বাংলাদেশের দুর্নীতির স্বরূপ উদঘাটনকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইতিমধ্যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে জাতির মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখা এবং বহিঃশক্রকে মোকাবেলা করা। তাদের অস্ত্র যখন জনগণ বা জনগণের নেতৃত্বের ওপর তাক করা হয় তখন আজ হোক কাল হোক যখন জনগণের সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে তখন সেই শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এক ব্যক্তির জন্যে সেনা বাহিনী ব্যবহৃত হওয়ার খেসারত কিন্তু সমগ্র বাহিনীকে দিতে হবে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। এটি সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। বাংলাদেশে এখন যার ক্ষমতা তিনি কি সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছেন? ­এই প্রশ্ন আজ আমরা মানুষের কাছ থেকে শুনি।   বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনাতো নতুন নয়। এটাকে বন্ধ করার স্থায়ী কোন পথ আছে কী? এটা বন্ধ করার একমাত্র পথ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের ক্রীড়নক হওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে রাজনীতিবিদরা তার দলের নেত্রীকে মাইনাস করতে চান, যে রাজনীতিবিদরা অন্য জায়গা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পান বা লালিত পালিত হন, যাদের আনুগত্য তাদের নেতৃত্বের প্রতি না হয়ে অন্যের প্রতি হয়, তাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে কোনো বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে সেই অবস্থার অবসান না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে অধিষ্ঠিতরা বার বার তাদের কলকাঠি নাড়বে। অনেক হয়েছে। ইনাফ ইজ ইনাফ। আমাদেরকে এখন বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। আমরা বিদেশী কোন প্রেসক্রিপশন চাই না। বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা অনেক কম। অল্পতে তারা তুষ্ট। আমাদের শ্রম বাজার বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের তুলনায় অনেক সস্তা। আমাদের রয়েছে কক্সবাজারের মত বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সমুদ্র সৈকত, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনা এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ ইতিহাস। সেই সাথে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য।

আপনারা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন তখনো আপনাদের দেখেছি বিদেশী দূতদের সাথে বসতে­ আপনাদের কর্ম ও বক্তব্য কি স্ব-বিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? আদৌ আমরা কি বিদেশী প্রেসক্রিপশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো?

রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকলে দেশী- বিদেশী দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সাথে বৈঠক করতে হয় এবং আমরাও সেটা করেছিলাম। ১/১১ এর ঘটনা কোনো বিদেশী প্রেসক্রিপশনে ঘটেনি। দূরে থেকে না জেনে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সেদিনের ঘটনাকে বিদেশী শক্তির ওপর চাপিয়ে দিয়ে ঘটনার মূল নায়কদের আড়াল করা হচ্ছে। সোজা কথা হচ্ছে এখন ভাসুরের নাম নিতে লজ্জা করার মতো ঘটনা। ১৯৭৫ সালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ১৯৯৬ সালে লেঃ জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশে কী ঘটেছিলো। এগুলো বাংলাদেশের মাটিতেই ঘটেছিলো। দেশী শক্তিমানরাই সেসব ঘটনা ঘটিয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনাও বাংলাদেশের মাটিতেই ঘটেছে। কেউ যখন কোন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তখন এর এ্যাকশন- রি-এ্যাকশন হয়। পাকিস্তানে ১৯৯৯ সালের ১২ আক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে যে ঘটনা ঘটেছিলো সেটিও আমেরিকা আগে জানতো না। ১/১১ এর তিন দিন আগে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিলো যে, বাংলাদেশে সামরিক শাসন আসছে। সেই দিন জরুরী অবস্থা নয় সামরিক শাসন জারি হবার কথা ছিলো। শেখ হাসিনাও জানতেন ১২ জানুয়ারির মধ্যে ঘটনা ঘটবে। তাকে বলা হয়েছিলো- বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করা হবে, মইনুল রোডের বাসভবন তছনছ করে ফেলা হবে। আমি তখন তাকে বলেছিলাম সবই ঠিক আছে আপনাকেও একইভাবে গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে চাননি। বলা হয়েছিলো তাদেরকে ক্ষমতায় আনা হবে। একই কথা বেগম খালেদা জিয়াকেও বলেছিলাম। তিনিও বিশ্বাস করতে চাননি। দুই নেত্রীর কাছে তাদেরকে ধরার বিষয়টি ছিলো বিস্ময়। আমি দুই নেত্রীর সাথে সমঝোতা করি- যারা পরবর্তীতে ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তারা তা চাননি।

 

রাষ্ট্রপতি হলেন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং আপনি ছিলেন তার উপদেষ্টা। এই ধরনের একটি লিখিত চিঠি পেয়ে আপনারা কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি?   আমরা মনে করেছিলাম আমাদের ক্ষমতার উৎস জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার ভরসাস্থল দুই নেত্রী। দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে আমরা কিছু করতে চাইনি, যেমনটি ১৯৯১ সালে তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ মনে করতেন। দুই নেত্রীর সমর্থন পেলে আমরা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। আমরা যদি সে দিন এমনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতো। প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসাবে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার বৈঠকটা সঙ্গত কারণেই সব মহলের কাছে গোপন রেখে করতে হয়েছিলো। আমাদের লক্ষ্য ছিলো আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন নয়। আমরা ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে কোন দলের ক্ষমতায় আসার সুযোগ ছিলো। নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির জন্য আমরা আওয়ামী লীগের যে সব দাবিদাওয়া মেনেছি সেটি ছিলো নজিরবিহীন। এর আগে কোনো কেয়ারটেকার সরকার সে ধরনের কাজ করেনি- বিশেষ করে ওয়াশিংটন, দিল্লি ও লন্ডনের প্রেস মিনিস্টার পদসহ দেশে- বিদেশে প্রায় ঢালাওভাবে আমরা রাজনৈতিক সরকারের দেয়া নিয়োগ বাতিল করেছিলাম। শেখ হাসিনা আমাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি পূর্বাপর আমাদের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। সেদিন দেখেছিলাম তিনি তার দলের গুটিকতক লোকের কাছে কতো অসহায়। প্রণব মুখার্জির কাছে আওয়ামী লীগের ৯ জন শীর্ষ নেতা লিখিতভাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। মার্কিন দূতাবাসেও নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করেছিলেন। এই বিষয়টি আমাদের পীড়া দিয়েছিল।

 

এরা কারা, তাদের নাম বলবেন কী?

শেখ হাসিনার সাথে আমার একান্ত বৈঠকে এগুলো স্থান পেয়েছিলো। আমরা দেশে শক্তিশালী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দেখতে চেয়েছিলাম। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ দিয়ে দল ভাঙ্গাগড়ার খেলায় আমরা জড়িত হইনি। আজ দেশবাসী ও বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছেন আমাদের আমলের সাথে পরবর্তী অবস্থা। বিচারের ভার জনগণের ওপর। ড. কামাল হোসেন ও ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী বার বার প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত চেয়েছিলেন। কিন্তু দুই নেত্রীসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রেসিডেন্টের বৈঠক, রাজনৈতিক সংকট সমাধান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড এবং সরকারের রুটিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদেরকে সাক্ষাত দিতে পারিনি। ডা. বি. চৌধুরী বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে আমাকে হাওয়া ভবন ও বিএনপির লোক বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন।

আমি তখন স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছিলাম যে, বি. চৌধুরী ছিলেন আগা গোড়া বিএনপির লোক এবং তার ছেলে মাহি বি. চৌধুরী ছিলেন হাওয়া ভবনের অন্যতম উদ্যোক্তা। তারেক রহমান একা হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠা করেননি। মাহিরা তার ডান হাত সেজে হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টিভির চাঙ্কগুলো নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন দিব্যি। বি. চৌধুরী বিএনপির এলিমেন্ট হিসাবে সংসদে বিরোধী দলীয় উপ- নেতা, সংসদ উপনেতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং সব শেষে দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছিলেন। পিতাপুত্র একই সংসদের এমপিও হয়েছিলেন। তারা যখন বিএনপি ও হাওয়া ভবনের বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন তখন শুধু বলেছিলাম – একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বিধিতে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা নির্ধারিত আছে। সংসদে কোনো রাজনৈতিক দলের ৩০টি আসন থাকলে সেটিকে রাজনৈতিক দল হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংসদে কোন দলের ১০টি আসন থাকলে সেটিকে গ্রুপ বলা হয়।

সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেয়ার আগে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল প্রধান প্রধান ৪টি রাজনৈতিক দলের সাথে প্রেসিডেন্টের সংলাপের আয়োজন করেছিলাম। আমাদের আসলে এই রাজনৈতিক দলগুলো ও দুই নেত্রীর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা, মন্ত্রী বা বিশেষ দূত হিসাবে আমার আলাদা সংলাপও সফল হয়েছিলো। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের মধ্যে বিএনপির ক্ষমতার শেষ দিকে যে সংলাপ হয়েছিলো তাতে ৩১ দফা দাবি শেষ পর্যন্ত এক দফায় পরিণত হয়েছিলো। আর সেটি ছিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে বিচারপতি কে এম হাসানকে নিয়োগ না করা। সেই সমস্যার সমাধান হয়েছিলো। বিচারপতি কে এম হাসান দায়িত্ব গ্রহণে অপাগরতা প্রকাশ করার সাথে সাথে আমি জনাব মান্নান ভুইয়া ও জনাব জলিলের সাথে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করে তাদেরকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসিয়েছিলাম। রাজনৈতিক কর্মসূচি তথা আওয়ামী লীগের অবরোধের মুখে এ দুই নেতাকে চাহিবা মাত্র পর্যাপ্ত পুলিশ এসকট দিয়ে আমরা সেদিন তাদেরকে বঙ্গভবনে এনেছিলাম। আমাদের সামনে সংবিধান নির্ধারিত ৬টি অপশন ছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের এ ৬টি অপশনের মধ্যে প্রথমটি ছিলেন বিচারপতি কে এম হাসান। তার অপারগতা প্রকাশের পর দ্বিতীয় অপশনে ছিলেন তার আগের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি মাঈনুল রেজা চৌধুরী। ইত্যবসরে তার ইন্তেকালের কারণে দ্বিতীয় অপশনটিও শেষ বা এগজসটেড হয়ে যায়।

তৃতীয় অপশনে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বশেষ বিচারপতি বিচারপতি এম এ আজিজ। তিনি তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সেদিন তাকে সিইসি হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি তুলেছিল এবং তিনি সিইসি হিসাবে অফিস অব প্রফিট হোল্ড করছিলেন, যেটি প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে অযোগ্যতার মধ্যে পড়ে। সেই কারণে তৃতীয় অপশনও শেষ হয়ে যায় এবং চতুর্থ অপশনে এর আগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বিচারপতি হামিদুল হকের নাম বিবেচনায় নিতে হয়। ইতিমধ্যে বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাবার আগে বিচারপতি হামিদুল হককে বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ করে। সেই হিসাবে তিনিও অফিস অব প্রফিট হোল্ড করছিলেন এবং তার ব্যাপারেও আপত্তি এসেছিল। বিচারপতি হামিদ তখন লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে, কোনো পক্ষ আপত্তি করলে তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেবেন না। এইভাবে চতুর্থ অপশন শেষ হয়ে যাবার পর আমরা সংবিধান নির্ধারিত পঞ্চম অপশনে যাই। এই অপশনে ছিলো বিদায়ী সংসদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ। সেই সূত্র ধরে আমরা প্রধান ৪টি রাজনৈতিক দল (বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর) সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে প্রেসিডেন্টের সংলাপের আয়োজন করি। সেই সংলাপে ৪টি দল একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির পক্ষে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।

বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি প্রেসিডেন্টকে সংবিধান নির্ধারিত পন্থায় পঞ্চম অপশন শেষ হয়ে যাবার প্রেক্ষিতে ৬ষ্ঠ ও সর্বশেষ অপশন অনুযায়ী দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করে। ২৯ অক্টোবর ২০০৬ সালে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়। এর আগের দিন বিকেলে বিচারপতি কে এম হাসানের অপারগতা প্রকাশ করার পর আমরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সেক্রেটারীদ্বয়ের সঙ্গে সংলাপ করছিলাম। তখন তারা দুই জনই প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন সংকটের সমাধানতো হয়েই গেল। আমরা দুইজন যেখানে পৌঁছেছিলাম এবং সমাধান করতে পারিনি­ মহামান্য রাষ্ট্রপতি এখনতো সেই সমস্যার সমাধান হয়েই গেছে। তখন আমরা পঞ্চম অপশন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীর নাম বিবেচনায় নিই। বিএনপির এক গ্রুপ তার পক্ষে। আর অপর গ্রুপের বিরোধিতার কারণে আসে আপত্তি। জনাব চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও তখন বলেছিলেন সব পক্ষ একমত না হলে তিনি বিতর্কিত দায়িত্ব নেবেন না। জনাব জলিল রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, সংবিধানের এ সংক্রান্ত অন্যান্য অপশন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে এবং যদি আমরা একমত হতে না পারি তাহলে প্রেসিডেন্টের সংবিধান অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণে আমাদের আপত্তি নেই- এই কারণে যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কিছু আগে যখন আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বিএনপির একটি অংশ ও হাওয়া ভবন আপনাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরাতে চেয়েছিলো তখন আমরাই আপনার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের দলে তোফায়েল আহমেদসহ আপনার অনেক ছাত্র আছে। আপনি দায়িত্ব নিলে আমরাই বেশি খুশি হবো। প্রেসিডেন্ট সেই সংলাপে বলেছিলেন আমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি। আপনারা যদি সমঝোতায় না আসতে পারেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনে দেশ ও জাতির স্বার্থে আই কুড অফার মাইসেল্ফ। জনাব জলিল সেই সংলাপ শেষে বঙ্গভবনের বাইরে এসে অপেক্ষমান টিভি ক্যামেরাগুলোর সামনে বলেছিলেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ’ সংকটের সমাধান হয়ে গেছে। আমরা ধানমন্ডিতে কিছুক্ষণের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও চৌদ্দ দলের বৈঠক শেষে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাবো। আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছি।

কিন্তু তিনি ধানমন্ডিতে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা সেদিন শেখ হাসিনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জলিলকে দালাল দালাল বলে সংকটের সমাধান হতে না দিয়ে আপত্তি উঠিয়েছিলেন। নেত্রীকে দিয়ে প্রেসিডেন্টের নাম বিকৃত করিয়ে ইয়াজউদ্দিনকে ইয়েস উদ্দিন বলানো হয়েছিলো। শেখ হাসিনার সাথে আমার বৈঠকের পর ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলের একটি কক্ষে শেখ হাসিনার প্রতিনিধিদের সাথে ফলোআপ মিটিং এ বসে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার জন্য বিভিন্ন দাবি দাওয়া মানার মাধ্যমে সংকট সমাধানের কাজ করেছিলাম। আমার বাসায় শেখ হাসিনার একজন প্রতিনিধি দুই দিন কেন গিয়েছিলেন সেজন্য তোফায়েল আহমেদ সুধা সদনে এসে আওয়ামী লীগের ঐ একনিষ্ঠ ব্যক্তিকে বিএনপির দালাল দালাল বলে চিৎকার করেছিলেন। এমন কি শেখ হাসিনা একা সামাল দিতে না পেরে শেখ রেহানাকে ওই সময় কেন ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেজন্যও একই ব্যক্তি সুধাসদনে গিয়ে রেহানাকে কেন আনা হলো চিৎকার করছিলেন। প্রেসিডেন্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আওয়ামী লীগের দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার আগেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও মহাজোট রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নিয়েছিলো।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল প্রেসিডেন্টের সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হয়েছিলো। শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্টের সাথে একান্ত বৈঠকও করতে চেয়েছিলেন এবং আমি সেই সুযোগও করে দিয়েছিলাম। সেদিন যে মহলটি চায়নি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনা হোক সেই মহলটি আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল। শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজ উদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বলেছিলেন­ আমরা নির্বাচনে আসতে চাই, আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনমুখী দল। যদিও কে এম হাসান ইস্যুর সমাধান হয়েছে তথাপি আপনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে একটু ভূমিকা নিয়ে যদি সিইসি বিচারপতি আজিজকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে সরানো সম্ভব না হয় নির্বাচন পর্যন্ত তাকে ছুটি দিয়ে হলেও আমাদের নির্বাচনে আসতে দিন। আমরা কোন সন্দেহের মধ্যে থাকতে চাই না। সেই দিন আমরা এ অসম্ভব কাজও আল্লাহর রহমতে সম্ভব করেছিলাম। যদিও এরপর তাদের বিশেষ করে তোফায়েল আহমেদের শেখ হাসিনার ওপর উপর্যুপরি চাপের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে অতিরিক্ত হিসাবে নির্বাচন কমিশনার শ. ম জাকারিয়াকেও আমরা ছুটিতে পাঠিয়েছিলাম। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেবল অংশই নেয়নি, ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় থাকার পর মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহরের জন্য দুই দিন সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ করলে আমরা তাও মেনে নিয়েছিলাম। সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগ জোট সাতদিন আর দুদিন মিলে মোট নয়দিন নির্বাচনে ছিলেন। সেই নির্বাচন কেন হয়নি? কেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলো? কেন সেদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছিলো? কারা সেটি করেছিলো? কারা প্রকাশ্যে ছিলো? কারা ছিলো নেপথ্যে? এগুলোর তদন্ত হলেই থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে। কারা সেদিন বিএনপিকে বলেছিলো আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন করতে হবে।

আর আওয়ামী লীগকে বলেছিলো একটির পর একটি দাবি দিতে হবে। আমরা ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করতে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করলে কে সেনাবাহিনীকে ইনএকটিভ করে আওয়ামী লীগকে আবার মাঠে নামিয়েছিল। লগি- বৈঠার কর্মসূচি কীভাবে হয়েছিলো? লগি- বৈঠার কর্মসূচির সময় সংঘাত, হত্যাকান্ড শুরুর পূর্ব মুহূর্তে কেন সেদিন পুলিশকে সরিয়ে নেয়া হলো? কারা সে দিন এ কাজগুলো করেছিলো? প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে কারা নিয়োজিত ছিলো এইগুলো তদন্ত করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলেছিলেন জেদের ভাত কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো। ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর আমাদের আমলে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঢাকা সেনা নিবাসের সেনাকুঞ্জে প্রতিবছরের মতো যে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় সেখানে এই প্রথম দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মাঝখানে দশটি চেয়ার বসিয়ে কৃত্রিম দূরত্ব সৃষ্টি করা হয়। প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। সেনাপ্রধান এভাবে বসার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে পরে জানা যায়। প্রেসিডেন্ট সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কও। আমরা প্রেসিডেন্টের সাথে ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমাদের পক্ষ থেকে সেনা বাহিনীর কর্মকর্তারা এ আয়োজন সম্পর্কে জিজ্ঞেস না করেই একটি পরিকল্পনা থেকে এভাবে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বসার ব্যবস্থা করেছিলো। এমন কি প্রেসিডেন্ট ছাড়া তারা যাদেরকে মনে করেছিলো কেবল তাদেরকেই ওখানে ঢুকতে দেয়া হয়েছিলো।

আশ্চর্যজনক হচ্ছে সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীকে প্রবেশ ও প্রস্থানে তারা এমনভাবে দিক দেখিয়েছিলেন যাতে কারো সাথে কারো দেখা না হয়। তাদের দুজনের সহযোগীদের সেখানে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এমন কি প্রেসিডেন্টের সার্বক্ষণিক প্রয়োজন জানা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী হিসাবে আমাকে সেখানে যেতে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। যেখানে সাংবিধানিকভাবে আমার নির্দেশ মানতে তারা বাধ্য, সেখানে আমাকে ঢুকতে না দেয়ার একটি কারণ ছিলো যাতে দুই নেত্রীকে এক জায়গায় না আনা হয়। দু’জনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কারণে তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাত হয়ে যেতে পারে এ ছিলো বিশেষ ব্যক্তির আশংকা। ওই ব্যক্তিটি সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে আমার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, একজন সিভিলিয়ান দেশ চালায়। অবশ্য তাকে অনেকে বলেছিলেন সংবিধান অনুযায়ী সিভিলিয়ানেরই দেশ চালানোর কথা। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর আমাকে সেনা কর্মকর্তারাই এ কথা জানিয়েছেন।

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024