বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম: গত ৩০শে জুলাই, ২০শে রমজান, ১৫ই শ্রাবণ জাতীয় প্রেস ক্লাবে জেএসডির এক গোলটেবিলে অংশ নিয়েছিলাম। বহু চড়াই উতরাইয়ের পরও স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক জনাব আসম আবদুর রবের যে কোন আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারি না। সেই ধারাবাহিকতায়ই ৩০শে জুলাই গোলটেবিলে অংশগ্রহণ। ইদানীং তেমন কেউ কাজের জন্য কাজ করে না। পত্রপত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কতটা জায়গা পাওয়া গেল সেটাই আগে বিবেচনা করে। এ গোলটেবিলও সেদিক থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রম ছিল না।
গোলটেবিলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, নাগরিক কমিটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্যের জাফর উল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, গণফোরামের এক নেতা অংশ নিয়েছিলেন। দুই পৃষ্ঠার চমৎকার একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করেছেন জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন। সভাপতি ছিলেন জেএসডির সভাপতি জনাব আসম আবদুর রব। গোলটেবিলে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বেলা ১১টায় সময় দেয়া ছিল, ১১-৩৫ মিনিটে পৌঁছে কিছুটা বিব্রতবোধ করছিলাম।
হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের কদম ফোয়ারা থেকে প্রেস ক্লাবে যেতে ১-২ মিনিটের স্থলে সেদিন ২৫ মিনিট লেগেছিল। দেশ যেমন এগোচ্ছে না, রাস্তাও তেমনি ফুরোয় না। সময়োপযোগী পদক্ষেপটির জন্য তাদের আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। জাসদ বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল। ৪২-৪৩ বছরে তারা ৪৩ খণ্ড না হলেও ৩-৪ খণ্ড অবশ্যই হয়েছে। তা-ও একজন নির্বোধের মতো কেন যেন জনাব আসম আবদুর রবকে অস্বীকার করতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় ছাত্রনেতাদের ভূমিকা আমার কাছে সূর্যের মতো উজ্জ্বল মনে হয়। এখন অনেক অন্ধকার থাকলেও সেই উজ্জ্বলতাই আমাকে আকর্ষণ করে। তাই অনেক আগ্রহ নিয়ে ছুটে যাই তাদের যে কোন অনুষ্ঠানে। আলোচনার সময় আলোচকরা যখন এটা ওটা বলেন তখন খেই হারিয়ে যায়। তবু কিছু বলা যায় না, কি বলবো, তারাও আলোচক। সেদিনও বক্তৃতার সময় এটা ওটা বলায় গোলটেবিলের গুরুত্ব অবশ্যই কিছু না কিছু ক্ষুণ্ন হয়েছে। নামাজে দাঁড়িয়ে যেমন কথা বলা যায় না, সভা সমিতিতেও তেমনটাই মনে করি। কথা বললে যেমন নামাজীর সঙ্গে আল্লাহর দিদার হবে না, তেমনি বক্তৃতার সময় দেশ ও জনগণ ছাড়া অন্য কিছু ভাবলে সাড়া পাওয়া যাবে না।
গোলটেবিলে বামে ছিলেন আবদুল মালেক রতন, ডানে মাহমুদুর রহমান মান্না। মান্না ভীষণ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলেন। সেদিনও অসাধারণ আলোচনা করেছেন। তবে বারবার মাইক বন্ধ হওয়ায় ছন্দপতন হয়েছে। আলোচনাই যদি প্রধান হয় তাহলে তিনি একজন নামকরা আলোচক। আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি পরিবর্তনে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপার থাকলে প্রশ্ন আছে। মাত্র ক’দিন আগে ১০ই জুলাই বিকল্পধারার সঙ্গে অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে বিকল্পধারা বাংলাদেশ এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ দুই বলয়ের বাইরে একটি রাজনৈতিক ঠিকানা সৃষ্টির প্রয়াসে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। সেদিনও তৃতীয় ধারা অথবা তৃতীয় শক্তি বলে কথাটি উঠেছিল। ৩০ তারিখেও সেই তৃতীয় শক্তি হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। গোলটেবিলে আমি তৃতীয় শক্তি শব্দটির সঙ্গে একমত হতে পারিনি। আমার জানামতে কেউ তৃতীয় হতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় না। যে কোন প্রতিযোগিতায় সবাই অংশ নেয় প্রথম হওয়ার জন্য। তাই ১০ তারিখ যেমন বলেছিলাম, ৩০ তারিখেও বলেছি।
আমরা জাতীয় প্রধান শক্তি বা প্রধান বিকল্প হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছি, তৃতীয় হওয়ার জন্য নয়। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা প্রধান বিকল্প শক্তির উদ্ভব। তার জন্য যতটা ছাড় দেয়া প্রয়োজন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু তা গামছা ছেড়ে নয়। গোলটেবিলটি খুবই সময়োপযোগী এবং খুবই কার্যকর হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে যদি এর কোন কার্যকারিতা না থাকে, একটা গতানুগতিক সেমিনারের মতো যদি হয়, তাহলে তেমন কোন মানেই হবে না। গোলটেবিলটি যত গুরুত্ব দিয়ে শুরু করা হয়েছিল ততটা গুরুত্ব নিয়ে শেষ হতে পারেনি।
ধারণাপত্রের উপস্থাপক জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতনও তার ব্যস্ততার জন্য শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। এত ব্যস্ততা নিয়ে জাতিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা যাবে না। আর যা-ই হোক কিছু ব্যস্ততা ত্যাগ করে জাতির এ দুঃসময়ে তাকে সময় দিতে হবে। আবদুল মালেক রতন গোলটেবিল বৈঠক ডেকে থাকতে পারবেন না, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ড. কামাল হোসেন ১২ মাসের ৯ মাস বিদেশে থাকবেন, তারপরও জাতিকে অসুস্থ রাজনীতির কবল থেকে মুক্তি দেবেন- এমনটা প্রত্যাশা করা যায় না। তবে আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি, নেতাদের বা দলের ঐক্য হোক বা না হোক জনতার ঐক্যের সময় এসে গেছে।
ঈদের আগে আর মানবজমিন-এর লেখা হবে না। মানবজমিন যদি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে ছাপতে চায় তাহলে যে ১৫ই আগস্ট আমাকে কাঙাল করেছে সেদিন হয়তো লিখবো। নতুবা বেঁচে থাকলে ১৮ই আগস্ট রোববার ছাপা হবে। তাই পাঠকদের অগ্রিম ঈদ মোবারক জানাচ্ছি। বেশ ক’দিন হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশে এসেছেন। কেউ বলছে শেষ কমিশন নিতে এসেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, এসেই যুবলীগের ইফতার পার্টিতে যে বোমা ফাটিয়েছেন সেটা মোটেই অকারণ নয়। তার কাছে খবর আছে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। এটা বলার মানে কমিশনের পাল্লা কিছুটা ভারি করা। হতেও পারে। দুর্জনের তো আর ছলনার অভাব নেই। যে কারণেই হোক সজীব ওয়াজেদ জয়ের সেদিনের মন্তব্যে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট লাভবান তো হয়ইনি বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শাপলা চত্বরে বাতি নিভিয়ে আলেমদের গুলি করে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, জয়ের কথায় তারচেয়ে খুব কম ক্ষতি হয়নি। এখন এসবের কিছুই তারা গায়ে মাখবে না। বুঝতে পারবে পরবর্তী পর্যায়ে যখন আর কিছুই করার থাকবে না। জানি মাতৃস্নেহ ভীষণ অন্ধ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্ধ মাতৃস্নেহ কারও জন্যই কখনও শুভ হয়নি, এক্ষেত্রেও তেমনটাই হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুত্রের বক্তব্য যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেছেন তাতে তার নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনের আর কোন সম্ভাবনা রইলো না। সারাদেশ পাগল হলে হয়তো তিনি জিতবেন জেনেও অন্যরা হারার জন্য নির্বাচন করবে। ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়- সেটা ২০০৮ সালেই শেষ হয়ে গেছে। ২০০৮ সালে ওয়ান ইলেভেনের কারিগরদের পাতানো নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ না করতো তাহলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করেও মহাজোট এক-দেড় বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারতো না। গণতান্ত্রিক দেশ বা সরকার বলে বর্তমান সরকারের গর্ব করার কোন কারণ নেই। এ সরকার পুরোপুরি অগণতান্ত্রিকও নয়। অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সরকারেরও একটা কমবেশি জবাবদিহি থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারের সেটুকুও নেই। এমন খামখেয়ালির সরকার বাংলাদেশ তো দেখেইনি, পৃথিবীর অন্য কেউ দেখেছে কিনা অনেক কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে। তাই সামনের দিনগুলো খুব একটা সহজ হবে না, বড় কঠিন হবে এবং সেটা মহাজোটের জন্যই বেশি হবে। যার কিছু নেই তার হারানোর ভয় কি? কিন্তু যারা জগদ্দল পাথরের মতো মানুষের বুকে চেপে আছেন তারা সেখান থেকে পড়ে কোথায় ঠাঁই পাবেন এটা তো অবশ্যই চিন্তার বিষয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে জয়ের মন্তব্য সমর্থন করেছেন তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তিনি মন্ত্রগুপ্তির শপথ ভঙ্গ করেছেন কিনা? মন্ত্রীদের গোপনীয়তার শপথ নিতে হয়, তার কাছে আনা রাষ্ট্রের গোপনীয় কোন কিছু অন্যের কাছে প্রচার বা প্রকাশ করবেন না। তার কাছে যে খবর আছে তা যদি জয়ের কাছেও থাকে তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি রাষ্ট্রের গোপনীয়তা জয়ের কাছে প্রকাশ করেছেন? আরেকটা কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেই। সরকারে থাকতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার খবর কখনও সরকারের প্রতিকূলে হয় না, কোনদিন হয়নি। ছোট্ট একটি ঘটনা বলি। রংপুরে এক উপনির্বাচন হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে তখন আতোয়ার রহমান খানের যুক্তফ্রন্ট সরকার, কেন্দ্রে মুসলিম লীগ সরকার। আতোয়ার রহমান খান গিয়েছিলেন রংপুর সার্কিট হাউজে। রংপুরের ডিআইবি ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নির্বাচনে আমাদের অবস্থা কি? ডিআইবি ইন্সপেক্টর বলেছিল, স্যার খুব ভাল। আপনাদের জয় সুনিশ্চিত। তারপরও ডিআইবি ইন্সপেক্টর সেখান থেকে সরছিল না, কাঁচুমাচু হয়ে হাত কচলাচ্ছিল। আতোয়ার রহমান খান অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এখনও কেন ওভাবে দাঁড়িয়ে আছো? কেন কাঁচুমাচু করছো? আমি বুঝেছি তো তুমি কি বলতে চাও।
গতকাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এসেছিল তাদেরও এই একই রকম বলেছো এই তো। ডিআইবি ইন্সপেক্টর এক গাল হেসে বলেছিল, জ্বি স্যার। তাদেরও বলেছি ফিল্ড খুব ভাল। জয়ের সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। পাঠক এবার বুঝুন, সরকারি খবর কতটা সঠিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জ্ঞানী মানুষ। গো-হারা হারার আগে তিনি এসব মানবেন কেন? সময় বড় নিয়ামক শক্তি। যার শ্রম এবং ঘাম না ঝরলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার লেখা ‘স্বাধীনতা ৭১’ হয়তো আলোর মুখ দেখতো না, সেই বড় চওনার অনিল বর্মণ গত ৩১শে জুলাই সকালে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বেশ কিছুদিন কিডনি রোগে ভুগছিলেন। কিডনি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আমি নিজেও তাকে কয়েকবার নিয়ে গেছি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত চলে গেল। আমার প্রথম বই ‘স্বাধীনতা ৭১’ লেখার সময় অনিল বর্মণ করটিয়া সা’দত কলেজের বাংলায় অনার্সের ছাত্র ছিলেন। আমি সব সময় মনে করতাম অনিল আমার চেয়ে ছোট। এই কিছুদিন আগে জেনেছি সে আমার থেকে বয়সে ছোট নয়, বেশ কয়েক বছরের বড়। কিন্তু অত দেরিতে তার কলেজে পড়ার কারণ মাঝখানে ছেদ পড়েছিল। ’৮৩ সালে বর্ধমানে গিয়ে একনাগাড়ে প্রায় ছয় মাস ‘স্বাধীনতা ৭১’-এর কপি করেছিলেন। বইয়ের এক জায়গায় ‘বাতাবরণ’ লেখা ছিল। তাকে তার অর্থ বোঝানো যাচ্ছিল না। শেষে টেলিফোনে ৩-৪ দিন চেষ্টা করে তার শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুব সাদিকের সঙ্গে কথা বলে অর্থ জানার পর সে তৃপ্ত হয়েছিলেন। বড় সাদামাটা মানুষ ছিলেন। বড় চওনা থেকে বর্ধমান যাওয়ার আগে সে কোনদিন বাইরের খাবার খায়নি। তাই বাড়ি থেকে রুটি বানিয়ে নিয়েছিলেন। বর্ধমান পর্যন্ত যেতে জাত যাবে বলে অন্য কোথাও আহার করেননি।
অথচ আমাদের বাড়িতে আমার সঙ্গে বসে খেতে কোনদিন কোন আপত্তি করেননি। কতই না ভালবাসতেন। অসুস্থ অবস্থায় অন্যের গলগ্রহ হয়ে কষ্ট করে বেঁচে থাকার চেয়ে যেখানে যেতেই হবে সেখানে চলে গেছেন। সেজন্য সবার কাছে তার আত্মার শান্তি কামনা করি। প্রার্থনা করি স্রষ্টা যেন তাকে ক্ষমা করেন।
সূত্র: মানবজমিন।
Leave a Reply