আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘আলামে বারযাখ’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।
দুই জিনিসের মধ্যেকার পর্দা ও আড়ালকে ‘বারযাখ’ বলে। ইহকাল ও পরকাল জীবনের মধ্যকার যে একটি জীবন রয়েছে, তাকেই ‘বারযাখ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ, মৃত্যুর পরপরই পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আর আখেরাতের জীবন তখন শুরু হবে, যখন সমস্ত মানুষকে পুনর্বার জীবিত করা হবে।
এর মধ্যকার জীবন যা কবরে বা পশু-পক্ষীর পেটে কিংবা পুড়িয়ে ছাই করে দিলে শেষ পর্যন্ত মাটির ধূলিকণা আকারে অতিবাহিত হয়, তাকে ‘বারযাখী জীবন’ বলে।
মানুষের এই অস্তিত্ব যেখানেই থাক আর যেভাবেই থাক, শেষ পর্যন্ত মাটিতে মিশে মাটিতে পরিণত হবে অথবা ছাই হয়ে হাওয়ায় উড়ে যাবে, অথবা সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হবে অথবা কোন জন্তুর খাদ্যে পরিণত হবে। পরিশেষে মহান আল্লাহ সকলকে এক নতুন অস্তিত্ব দান করে হাশরের মাঠে জমা করবেন।
মৃত্যু যেমন সকলের জন্যই অনিবার্য ঠিক তেমনি পরকালের জীবনও সকলের জন্য অবশ্যম্ভাবী। পরকালকে ২ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
১) আলামে বারযাখ (অন্তরাল/পর্দা) ২) আলমে হাশর। আমি আজ অতিসংক্ষেপে আলোচনা করব ‘আলমে বারযাখ’ নিয়ে–
আলামে বারযাখঃ আলামে বারযাখই হচ্ছে ১ম স্টেশন। মানুষের রুহ/আত্মা মৃত্যুর পর পুনরুথানের দিবস পর্যন্ত এই জগতে অবস্থান করবে। (মুমিনুন-১০০)। এটা এমন জায়গা যেখান থেকে না পৃথিবীতে ফিরে আসা যায় আর না জান্নাতে বা জাহান্নামে চলে যাওয়া চলে যাওয়া সম্ভব!! বারযাখ ২ ধরনের-
ইল্যিয়িনঃ পবিত্র রুহ রাখার স্থান।আর এখানে জান্নাতের পরিবেশ বিরাজ করবে! (মুমিন:৪৫,৪৬)
সিজ্জিনঃ অপবিত্র তথা পাপী রুহ রাখার স্থান।আর সেখানে জাহান্নামের পরিবেশ বিরাজ করবে!! (নাহল:২৮)
ক্ববরঃ কোন লাশ জীব-জন্তুতে খেয়ে ফেললে অথবা আগুনে পুড়িয়ে দিলে অথবা সাগরে ভাসিয়ে দিলেও আলমে বারযাখে ইল্যিয়িনে অথবা সিজ্জিনে অবস্থান করবে। আর ক্ববরের আযাব বলতে ইল্যিয়িন ও সিজ্জিনের অবস্থার কথাই বুঝানো হয়েছে! তবে ক্ববরের আযাব শুধু রুহ অথবা দেহ নাকি উভয়ের উপরেই হয় এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সুতরাং ক্ববরের আযাবের উপর ঈমান আনা ওয়াজিব কিন্তু এর পদ্ধতি জানা অসম্ভব!
১) শুধু জুমার দিনই নয় যখনি আমরা দরুদ পাঠ করি তা নবী(ছাঃ)এর ক্ববরে ফেরেশতারা পৌছে দেয়।
২) নবী-রাসুল (আ)দের দেহ সাধারণ মানুষের মত পচে গলে যায় না!
৩) বারযাখের জীবনে নবী-রাসুল(আ), সিদ্দিকসহ সকল মুমিন ব্যক্তির রুহ পাখি হয়ে জান্নাতী পরিবেশে বিচরণ করে জান্নাতি ফল-ফলাদি খেয়ে থাকে কিন্তু শুধু শহীদদের রুহ পাখির উদর/পেটে অবস্থান করে এবং খাবার খায়। আরেকটি মজার বিষয় রুহগুলো সারিবদ্ধভাবে সৈনিকদের মত অবস্থান করে এবং প্রমাণ হয় রুহ সৃষ্ট, অসৃষ্ট নয়! অন্যদিকে কাফির, পাপীদের রুহগুলো জাহান্নামের পরিবেশে অবস্থান করে এবং আযাব আচ্ছাদন করতে থাকে। (নাহল: ২৯)
৪) বারযাখের জীবনে যারা অবস্থান করছে তারা, না আমাদের সম্পর্কিত বিষয় সমুহ জানে, আর না আমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে! কেননা রুহগুলো সাত আসমানের উপরে ইল্যিয়িনে অথবা সাত জমীন নিচে অবস্থান করছে।।(নাহল: ২৯,হাজ্জ: ২১)
৫) কেউ মারা গেলে অন্যেরা পৃথিবীবাসী আত্মীয়-স্বজন,অবস্থা সম্পর্কিত বিষয়ে জানতে চায়।
৬) কাফিরদের রুহুর জন্য আসমানের দরজা খোলা হয় না।
৭) মৃতরা বারযাখের জীবনে শুধু শুনে তাই নয় বরং তারা সেখানে কথা বলে,দেখে, চিনে, পানাহার করে, উঠাবসা করে, আরাম আনন্দ, দুঃখকষ্ট উপভোগ করে, ঘুমায়, জেগে থাকে, আসা-আকাং্খা পেশ করে, মৃত ব্যক্তি উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করে কিন্তু এগুলো দুনিয়ার জীবনের মত নয়। বরং তা দুনিয়ায় জীবন থেকে ভিন্নতর। (বুখারী, মুসলিম সহ হাদীছের কিতাবসমুহে বিদ্যমান)
আলামে আরওয়াহার (রুহুর জগত) জীবনের সাথে যেমন আলমে আরহামের (মাতৃগর্ভ) মিল নেই আবার আলমে আরহামের সাথে মিল নেই আলমে আজসাম (দুনিয়ার দেহের জীবন)! ঠিক তেমনি কোন মিলই থাকবেনা এই আলমে আজসামের/এই দুনিয়ার জীবনের সাথে আলমে বারযাখ বা ক্ববরের জীবনের!
এ কথায়, দুনিয়ার জীবনের তুলনায় তারা মৃত কিন্তু বারযাখের জীবনের তুলনায় জীবিত! এটা ইলমে গায়েবের বিষয়! এটা নবী-রাসুল (আ)ব্যতীত দেখেন নি! পৃথিবীর জীবিত কোন ব্যক্তির এটা জানা বা দেখা অসম্ভব!
অনুবাদ
(ক্ববরে) তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করা হয় আর যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন (বলা হবে) ফেরাউনের জাতি গোষ্ঠীকে কঠিন ‘আযাবে প্রবিষ্ট কর।
সূরার নাম ঃ আল মু’মিন আয়াত নম্বরঃ ৪৬
এই আগুনের সম্মুখে বারযাখে অর্থাৎ, কবরে তাদেরকে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। এ আয়াত থেকে কবরের আযাবের কথা প্রমাণ হয়, যা অনেকে অস্বীকার করে। হাদীসমূহে তো খুবই স্পষ্টতার সাথে কবরের আযাবের কথা বলা হয়েছে।
যেমন, আয়েশা (রাযিআল্লাহু আনহার) প্রশ্নের উত্তরে একদা নবী করীম (সাঃ) বললেন, نَعَمْ عَذَابُ الْقَبْرِ حَقٌّ “হ্যাঁ, কবরের আযাব সত্য। (বুখারীঃ জানাযা অধ্যায়)
অনুরূপ আর একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, যখন তোমাদের মধ্যে কেউ মৃত্যু বরণ করে, তখন (কবরে) সকাল ও সন্ধ্যায় তাকে তার স্থান দেখানো হয়।
অর্থাৎ, সে জান্নাতী হলে জান্নাত এবং জাহান্নামী হলে জাহান্নাম তার সামনে পেশ করা হয় এবং বলা হয় যে, এটাই হল তোমার আসল ঠিকানা, যেখানে কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তোমাকে পাঠাবেন। (বুখারী, মুসলিমঃ জান্নাত অধ্যায়)
Leave a Reply