রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০৩

ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের কর্মহীনতার নেপথ্যে অলসতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব

ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের কর্মহীনতার নেপথ্যে অলসতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব

ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাব ও রাষ্ট্রীয় সুবিধার ওপর নির্ভরশীলতা দুটোইরই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিশেষত নারীদের মধ্যে উচ্চহারে অর্থনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধার ওপর উল্লেখযোগ্য নির্ভরতা রয়েছে।

অন্যদিকে, ওই কমিউনিটিতে দেখা যায় শক্তিশালী উদ্যোক্তা মনোভাব, যা রেস্টুরেন্ট শিল্পের মতো খাতগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে।

কেবল অলসতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব থেকে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বরং এর পেছনে রয়েছে নজীর‌বিহীন সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক একাধিক কারণ।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূদের মধ্যে উচ্চহারে কর্মহীনতার নেপথ্যে কেবল কর্মোদ্যমে নয় বরং, বিষয়টি নির্দিষ্ট জনসংখ্যাগত ও সামাজিক কারণ দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত।

অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে লিঙ্গ বৈষম্য একটি বড় কারণ। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারীদের ৪৮ শতাংশ অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, পুরুষদের ক্ষেত্রে যে হার ১৯ শতাংশ।

এর পেছনে প্রায়শই সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি জড়িত, যেখানে নারীরা ঐতিহ্যগতভাবে প্রাথমিক পরিচর্যাদানকারী (কেয়ারগিভার)।

শিশুদের দেখভালে লোক নিয়োগ ব্যয়বহুল হওয়ায় এবং পেশাদার নেটওয়ার্ক ও কর্মজীবনের সহায়তার সীমিত প্রবেশাধিকার এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

ওই জরিপে আরও দেখা যায়, ওই কমিউনিটির অর্থনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার মোট হার ছিল ৩৩ শতাংশ, যেখানে যুক্তরাজ্যের জাতীয় গড় ২২ শতাংশ।

সরকারি ভাতার ওপর নির্ভরতার ক্ষেত্রে, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এবং কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটির মধ্যে সরকারি সুবিধা গ্রহণের হার সর্বোচ্চ ছিল, যেখানে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত তিন বছরে ২৪ শতাংশ পরিবার এই ধরনের সুবিধা পেয়েছিল। এর বিপরীতে, চীনা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সুবিধা গ্রহণের হার ছিল সর্বনিম্ন।

প্রথম প্রজন্মের অনেক বাংলাদেশি অভিবাসীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং দক্ষতার অভাব তাদের জন্য মূলধারার শ্রম বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বড় বাধা তৈরি করেছে। অনেকে সীমিত ইংরেজি ভাষা দক্ষতা এবং নামমাত্র যোগ্যতা নিয়ে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন।

এর ফলে তারা পদ্ধতিগত বৈষম্যের পাশাপাশি প্রায়শই তারা স্বল্পদক্ষতা ও অল্পমজুরিভিত্তিক কাজেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।

যারা এ সুযোগটিও পেতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের জন্য কর্মহীনতা এবং সরকারি ভাতার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না।

তাদের আর্থিক অবস্থার কারণে পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষেও নিজেদের উন্নতির পথ সীমিত হয়ে পড়ে।

সর্বোপরি, পারিবারিক কাঠামো এবং দারিদ্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পরিবারে শিশু ও বয়স্ক আত্মীয়স্বজনসহ নির্ভরশীলদের সংখ্যা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

একজন মাত্র উপার্জনকারী অথবা সেটাও না থাকলে, রাষ্ট্রীয় সহায়তা ছাড়া ভরণপোষণ স্বাভাবিকভাবেই কঠিন হয়ে পড়ে।

এ কারণেই ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পরিচালিত জরিপে দেখা যায় মধ্যে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পরিবারের ৪১ শতাংশ শিশু নিম্ন আয়ের পরিস্থিতিতে বসবাস করত।

ব্রিটেনের সরকারি তথ্য থেকে দেখা যায়, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা স্ব-কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে।

২০২১ সালের ব্যবসার মালিকানার তথ্য অনুযায়ী, জাতিগত সংখ্যালঘুরা মোট উদ্যোক্তার ১২ শতাংশ দখল করে আছে, যার মধ্যে ভারতীয় ৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ২ দশমিক ১ শতাংশ।

আর্থিক পরিস্থিতি উন্নতির জন্য অনেকের কাছে তখন স্ব-কর্মসংস্থানের আয়োজন করাই একমাত্র কৌশলগত পন্থা।

চাকরি বাজারে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং যোগ্যতার বাধা এড়িয়ে উপার্জনের জন্য অনেকের জন্যই ভালো উপায় হচ্ছে ব্যবসা করা। চাকরির জন্য অপেক্ষা না করে, তারা নিজেরাই নিজেদের সুযোগ তৈরি করেন।

এটি রেস্টুরেন্ট এবং ক্যাটারিং খাতে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যেখানে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের একটি দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি রয়েছে। ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের ব্যবসাগুলো প্রায়শই পরিবারভিত্তিক হয়ে থাকে।

ব্যবসাগুলো ক্ষুদ্র পরিসরে বা সীমিত মুনাফায় পরিচালিত হতে পারে, তবুও তারা স্বাধীন উপার্জনের একটি স্পষ্ট পথ তৈরি করে।

নিম্ন আয়ের পরিস্থিতিতে থাকা পরিবারগুলোর জন্য নিম্ন-মজুরির চাকরির চেয়ে ব্যবসার মাধ্যমে সম্মানজনক আয় এবং স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এটি তাদের সন্তানদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবেও দেখা হয়, যা এই সম্প্রদায়ের সাফল্যের একটি মূল প্রেরণা।

কর্মহীনতা এবং সরকারি ভাতার ওপর নির্ভরশীলতার উচ্চ হার সবসময় আলসেমির লক্ষণ নয়, বরং এর পেছনে অনেক ক্ষেত্রে জটিল ঐতিহাসিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের প্রভাব রয়েছে।

আর উদ্যোক্তা মনোভাব হলো সেই প্রতিক্রিয়া, যা ব্রিটিশ সমাজের এই অংশকে নিজেদের শর্তে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়তে সাহায্য করছে।

ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সম্প্রদায়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা একদিকে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং অন্যদিকে দাঁত কামড়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতার দ্বৈত চিত্র তুলে ধরে।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2025