আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘রুহ কি?’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।
রুহ শব্দের সমার্থক শব্দ প্রাণ বা আত্মা। মানুষ তার রুহের ওপর ভালো-মন্দের অনুভব করতে পারে নিজের কর্মে। পবিত্র আল-কোরআনে ২৩ বার রুহ শব্দ এসেছে। আধ্যাত্মিক এবং ইসলামিক দার্শনিকরা রুহকে তিনটি অর্থে বর্ণনা করেছেন।
এক. রুহ হলো সেই না-দেখা বস্তু, যা মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা হয়। দুই. রুহ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে জিবরাইল (আ.)-এর জন্য অর্থাৎ কোরআনের কোনো কোনো লাইনে রুহ বলতে জিবরাইলকে বোঝানো হয়েছে।
যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে রুহুল কুদ্দুস জিবরাইল সত্যসহ কোরআন নাজিল করে।’ (সুরা নাহল, আয়াত ১০২) তিন. কখনো কখনো রুহ শব্দ এসেছে কোরআন ও ওহির প্রকাশ বোঝানোর জন্য। রুহ এমন একটি বস্তু, যা প্রতিটি মানুষের ভেতরে সত্য ও মিথ্যার সঞ্চালক বার্তা আদান-প্রদান করে থাকে।
পবিত্র কোরআনে অন্তত ২৩ বার ‘রুহ’ শব্দ এসেছে। বাংলা ভাষায় এর পরিচিত অর্থ হলো প্রাণ বা আত্মা। রুহ হলো সেই অলৌকিক বস্তু, যা মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা হয়। রুহ এমন অশরীরী বস্তু, যা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না।
কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীর শক্তি ও সামর্থ্য এই রুহের মধ্যেই লুক্কায়িত। এর প্রকৃত স্বরূপ কেউ জানে না। রুহের অবস্থানক্ষেত্র হচ্ছে দেহ। যখন দেহ থেকে রুহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন দেহ থেকে প্রাণও চলে যায়। রুহ সৃষ্ট বস্তু। তবে দেহের মৃত্যুর কারণে রুহ মৃত্যুবরণ করে না। রুহের দেহত্যাগ এবং দেহ থেকে রুহের বের হয়ে যাওয়াই মৃত্যু।
রুহ সম্পর্কে একটি বিস্ময়কর তথ্য হলো, রুহগুলো সেনাবাহিনীর মতো সমবেত।
মানব সৃষ্টির সূচনা থেকেই রুহগুলো পরস্পর একত্র। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘সব রুহ সেনাবাহিনীর মতো একত্র ছিল। সেখানে তাদের যেসব রুহের পরস্পর পরিচয় ছিল, এখানেও তাদের মধ্যে পরস্পর পরিচিতি থাকবে। আর সেখানে যাদের মধ্যে পরস্পর পরিচয় হয়নি, এখানেও তাদের মধ্যে পরস্পর মতভেদ ও মতবিরোধ থাকবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৩৩৬)
রুহের পরিচয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আর তারা তোমাকে রুহ (আত্মা) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে, বলে দাও, রুহ হলো আমার রবের আদেশ। আর তোমাদের খুব সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। (সূরা বানি ইসরাইল : ৮৫)। রুহ সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সূরা বানি ইসরাইলের ৮৫ নাম্বার আয়াত।
আলোচ্য আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসিকার আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার আমি রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে মদিনার খেতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম।
রাসূল (সা.)-এর হাতে একখানা খেজুরের ডালের ছড়ি ছিল। চলতে চলতে তিনি ইয়াহুদিদের এক দল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তারা পরস্পর একে অন্যকে বলল, তোমরা তার কাছে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন কর। কেউ কেউ বলল, তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করো না।
রাবী বলেন, অতঃপর তারা রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, তারা বলল, হে মুহম্মাদ! রুহ কী? রাসূল (সা.) ছড়ির ওপর ভর দিয়ে থাকলেন। রাবী বলেন, আমি ধারণা করলাম, এখন তার ওপর ওহি অবতীর্ণ হবে।
অতঃপর তিনি বলেন, ‘তোমাকে উহারা রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, রুহ আমার প্রতিপালকের আদেশ ঘটিত। এবং তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড : ৬, পৃষ্ঠা : ৩৬৫)। আল্লামা ইকবাল উদ্ধৃত আয়াতের অনুবাদ করেছেন এভাবে, ‘তারা তোমাকে আত্মার কথা জিজ্ঞেস করছে। বল, আত্মা আমার প্রভুর ‘আমর’ (আদেশ) থেকে উদ্ভূত; কিন্তু জ্ঞানের মাত্র সামান্য অংশই তোমাদের দেওয়া হয়েছে।’
আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্যার ইকবাল লিখেছেন, ‘উদ্ধৃত বাক্যের অর্থ এই যে, আত্মার মৌলিক প্রকৃতি হলো নির্দেশাত্মক; কেননা আত্মা আসছে আল্লার নির্দেশমূলক স্পৃহা থেকে। অবশ্য ঐশী ‘আমর’ খুদীরূপে কীভাবে কাজ করে তা আমাদের জানা নেই।
খুদীর প্রকৃতি ও আচরণ সম্পর্কে আরও কিছু আলোক সম্পাত হয় ‘রাব্বী’ (আমার প্রভু) কথাটিতে যেভাবে ‘আমর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার থেকে। এর অর্থ হলো আত্মার একত্বের সীমা, সামঞ্জস্য বা কার্যকারিতার সহস্র বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাকে যে একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট কিছু বলে মেনে নিতে হবে তার প্রতি কুরআনে ইঙ্গিত রয়েছে।
Leave a Reply